ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধরা শুচি করার বৃষ্টি, বৎসরের আবর্জনা দূর

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ১১ এপ্রিল ২০১৯

ধরা শুচি করার বৃষ্টি, বৎসরের আবর্জনা দূর

মোরসালিন মিজান ॥ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক...। ক্রমে দূর হচ্ছে আবর্জনা। সারা বছর জমা হওয়া ময়লা ধুয়ে নিচ্ছে বৃষ্টি। চৈত্রের বর্ষণ, হ্যাঁ, দুর্ভোগ কিছুটা বাড়িয়েছে। একইসঙ্গে সাফসুতরো করছে শহর ঢাকাকে। আর মাত্র ক’দিন পর বিদায় নেবে পুরনো বছর। স্বাগত জানানো হবে নতুন ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে। এ সময়টাতে বাঙালীর কত রকমের প্রস্তুতি! নববর্ষের আগে গ্রামীণ নারীরা যত্ন করে ঘর দোর পরিষ্কার করেন। পানি ছিটান। অবেলার বৃষ্টি যেন তা-ই করে চলেছে। ১৭ চৈত্র কালবৈশাখীর সঙ্গে যে বৃষ্টি নেমেছিল, সেটিকে শুরু বলা যায়। এর পর থেকে নিয়মিত বিরতিতে কাঁদছে আকাশ। উত্তরে রাজশাহী, মধ্যাঞ্চলে ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এরই মাঝে বৃষ্টি হয়েছে। হচ্ছে। গত সোমবার ঢাকায় সূর্য তেমন দেখাই গেল না। মুখ ভার করে ছিল আকাশ। দফায় দফায় বৃষ্টি। মোট পরিমাণ ৫১ মিলিমিটার। পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। এভাবে চলমান আছে। চৈত্রের বৃষ্টির ভাল ফল এই হয়েছে যে, শহর ঢাকাকে যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন লাগছে এখন। কোন কোন রাস্তাঘাট দেখে, গাছের সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে চমকিত না হয়ে পারা যাচ্ছে না। এর আগের সময়টার কথা স্মরণ করতে হবে, শীতের কাল ছিল। বৃষ্টিহীন বসন্ত ছিল। তারও আগে থেকে রাস্তা কাটা। এখানে ওখানে গর্ত খুঁড়ে মাটি তোলা হয়েছে। সূর্যের তাপে সে মাটি শুকিয়ে ধুলো হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। গাড়ির চাকার নিচে আরও গুঁড়ো হয়ে দিগি¦দিক উড়ে গেছে। এভাবে শহর ঢাকা ময়লায় ঢাকা পড়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ জরিপেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে আছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। ৯১টি দেশের ১ হাজার ৬০০টি শহরের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সবচেয়ে বেশি দূষিত ২৫টি শহরের নাম পায় তারা। এ তালিকায় রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং অতি অবশ্যই ঢাকা। রাজধানীর রাস্তা সংলগ্ন বহু গাছ এই বিপর্যয়ের বড় সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিবর্ণ গাছের পাতায় কয়েক স্তর ধুলো জমে কালো হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক বৃষ্টি সেখানে সবুজের সমারোহ এনে দিয়েছে। ফুলগুলো আরও সুন্দর। ¯িœগ্ধ। নিজের চারপাশে একটু খেয়াল করলে যে কেউ অনুভব করতে পারবেন এই পরিবর্তন। বুধবার রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে আসার সময় প্রতিটি গাছকে নতুন মনে হচ্ছিল। কচিপাতাগুলো হালকা সবুজ। পুরনো পাতার গাঢ় সবুজ রং। দেখতে কী যে ভাল লাগে! ফুলহীন কদম গাছের পাতাও আকর্ষণ করছিল খুব। বিকেলে পার্কে হাঁটছিলেন ড. শাহীনা আক্তার। একটি সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। বললেন, এত বৃষ্টি হচ্ছে, দেখছিলাম কদম ফুটেছে কিনা। না, ফুল ফোটেনি। কিন্তু পাতার সবুজ যেন চুইয়ে পড়ছে! মনে হচ্ছে কেউ একটি একটি করে পাতা ধুয়ে দিয়েছে। দেখুন দেখুন বলে এই প্রতিবেদককেও কাছে ডাকলেন তিনি। পাতাগুলো খেয়াল করতে বললেন। সংসদ ভবন এলাকার গাছগুলোও সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। একটি আম গাছে কুকড়া চুলের মতো ঘন সবুজ পাতা। বৃষ্টি শেষে এক চিলতে রোদ এসে পড়তেই চিকচিক করছিল। একই দিন মনিপুরী পাড়ার একটি ভবনের ছাদ থেকে দেখা হলো যথেষ্ট উপরের দিকে ওঠে আসা কাঁঠাল গাছটি। আগেও দেখা হয়েছে। তখন অল্পস্বল্প বৃষ্টি। পাতায় জমে থাকা ধুলো কেমন মাখামাখি হয়ে আছে। এবার বেশি বৃষ্টিতে ধুয়ে পরিষ্কার! জাম গাছটাও বৃষ্টির জলে ¯œান করে ফল দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বসন্তে বাগান ভর্তি ফুল। প্রতিনিয়ত বৃষ্টিতে ধোয়া ফুলের আয়ু বেড়ে গেছে বলেই জানাচ্ছেন ফুলপ্রেমীরা। রাস্তাগুলো চকচক করছে। মিন্টু রোড, এয়ারপোর্ট রোড, ফুলার রোডসহ অনেক রাস্তা হেঁটে দেখা গেছে, ঝকঝকে। হঠাৎ দেখায় মনে হয় ব্রাশ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করা হয়েছে। চৈত্রের বর্ষণে বুড়িগঙ্গার জলও কিছুটা রং পাল্টিয়েছে। কী যে কালো আর কুৎসিত পানি এখানে এসে জমা হয়! দুর্গন্ধে টেকা যায় না। কিন্তু বৃষ্টির স্বচ্ছ পানি। ঢের বৃষ্টি হওয়ায় পানিটা পানির মতো দেখতে হয়েছে। দুর্গন্ধটাও আগের চেয়ে কমেছে। খেয়া নৌকোর মাঝি সিরাজ উদ্দীন বলছিলেন, বৃষ্টি হইলে আমাগো কিছুটা সমস্যা। যাত্রী কইমা যায়। এরপরও আমরা ধরেন বৃষ্টিতে খুশি। পানি বোঝা যায় এখন। গন্ধটা নাকে কম লাগতাছে। ঢাকার বন্ধ ড্রেনগুলোও পানির ধাক্কায় সচল হচ্ছে। যেসব ময়লা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের চোখ এড়িয়ে যায় সেগুলোও ঠেলে বের করে দিচ্ছে বৃষ্টি। ব্যস্ত আসা যাওয়ার পথে মানুষের গায়ে যে ময়লা, সেখানেও জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি। এভাবে বৎসরের আবর্জনা দূর হচ্ছে। শুচি হচ্ছে ধরা। সব দেখে বলাই যায়, প্রকৃতি বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে গ্রীষ্মের চোখ রাঙানো দেখেছি আমরা। গরমে হাঁসফাঁস করছিলেন নগরবাসী। মাটিও উত্তপ্ত ছিল। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত পানি ছিটানো বা রাস্তা ভিজিয়ে রাখার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। গাড়ি দিয়ে দিনে ৩ থেকে ৪ বার পানি ছিটানো হয়েছে। এর পরও সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে মাটি শুকিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যেত। বৃষ্টির কারণে আপাতত সেটি করতে হচ্ছে না। দুর্ভোগ থাকলেও, বৃষ্টিতে আরও কিছু উপকার হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে, আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চৈত্রের বৃষ্টি কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। এই বৃষ্টিতে শহর সুন্দর হোক। শুদ্ধ হোক। যত জরা, যত গ্লানি ঘুচে যাক। নববর্ষের প্রাক্কালে বাঙালীর তা-ই প্রত্যাশা।
×