ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

১১ এপ্রিল, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১১ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ

১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল দিনটি ছিল রবিবার। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অল ইন্ডিয়া রেডিও’র শিলিগুড়ি কেন্দ্রকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লেখ করে সেখান থেকে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন। এরপরেও বেশ কিছুদিন ঐ কেন্দ্র হতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণসহ আরও নানাবিধ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বোনেরা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশ তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত। আমাদের এ সংগ্রামে জয়লাভ করতেই হবে এবং আমরা যে জয়ী হব তা অবধারিত। তিনি আরও বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করা। মনে রাখবেন, আমরা আজ শত্রুর ওপর পাল্টা হামলায় নিয়োজিত আছি। আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণী বা দল নেই। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালী, আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের বাঙালী হিসেবেই হত্যা করছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের ঐক্য বজায় থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কেন, দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারবে না। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রেরিত এক পত্রে বলেন, চীন সরকার মনে করে বর্তমানে পাকিস্তানে যা ঘটছে তা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার। চীনা নেতা পাকিস্তানকে আশ্বাস দেন, ভারত পাকিস্তানে হামলা চালালে চীনা সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন দেবে। এই দিন পাকসেনারা স্থানীয় দালালের সহায়তায় প্রথমে গোপালগঞ্জ প্রবেশ করে। পরে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি মানিকহার আক্রমণ করে। পাকসেনাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে তারা মানিকহার ঘাটি জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বহর কালিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ সংবাদ পেয়ে কালামিয়া আশপাশের গ্রাম থেকে দশজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে কালিগঞ্জের এক মাইল দূরে এ্যামবুশ করে। উক্ত এ্যামবুশে তিনটি গাড়ি সম্পূর্ণ নষ্ট হয় এবং দশজন পাকসেনা নিহত হয়। গ্রেনেড নিয়ে পাকবাহিনীর একটি গাড়ির পিছু ধাওয়া করলে কালামিয়া বুলেট বিদ্ধ হন এবং সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন। ফুলবাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের তীব্র যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ব্যাটালিয়ন চরখাই চলে আসে এবং সেখানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। পাকবাহিনী যাতে চরখাই আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানি ফুলবাড়ি চরখাই রোডে, মেজর মোঃ আনোয়ার হোসেনের কোম্পানি ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে ডিফেন্স নেয় এবং লে. মোখলেসের কোম্পানিকে ডেপথ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়। সকালে পাকসেনারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঈশ্বরদী প্রবেশ করে। পাকসেনাদের গুলিতে রেলগেটে মজিদ নামের একজন কুলি শহীদ হন। ঈশ্বরদীতে পাকসেনাদের প্রবেশের পর পরই অবাঙালীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বাঙালী নিধন অভিযানে নামে। নূর মহল্লা ও ফতে- মোহাম্মদপুর এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে অবাঙালীরা হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজে অংশ নেয়। রাতে এ-দুটি মহল্লায় তারা ৩২ জন বাঙালীর প্রাণ হনন করে। বেনাপোল সড়কে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর্টিলারী, মর্টার, ট্যাংক এবং অন্যান্য আধুনিক মারণাস্ত্রের সাহায্যে আঘাত হানে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় ও অনেকে আহত হয় এবং বেশ কিছু পাকসেনা নিহত হয়। লে. শমসের মুবিন গুরুতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হন। সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পেছনে সরে আসে। ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়। লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। তাজউদ্দীন আহমদ নিম্নোক্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করেন, ১. সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফ, ২. চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমান, ৩. ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে মেজর কেএম সফিউল্লাহ, ৪. কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে ইপিআর মেজর আবু ওসমান। বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তারপর দিল্লী কেন্দ্র, বিবিসিসহ বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যম এই সংবাদ প্রচার করে। এই সংবাদে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ও মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সাহস, আস্থা ও যুদ্ধ বিজয়ের মনোভাব তৈরি করে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকল্পে এগিয়ে আসে। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে সর্বত্র। এই দিন ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ ১৪ এপিল প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামে ভারতীয় ভূমিকা সম্পর্কে চীনা পত্রিকা পিপলস ডেইলির ভাষ্য, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা কি করার চেষ্টা করছে? ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের পুনঃপুন তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করেছে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাবলী যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, তা একান্তই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যার ওপর কোন দেশের নাক গলানোর অধিকার নেই। অমৃতবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপক নিন্দা জানিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। বার এ্যাসোসিয়েশনের সভায় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র ও গণতান্ত্রিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অযাচিত হত্যা, বৃদ্ধ, যুবতী, নারী ও শিশুদের অমানবিকভাবে হত্যার খবর সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এ্যাসোসিয়েশন পাকিস্তান সামরিক সরকারের কাজের নিন্দা করেছে। বর্ধমান বার এ্যাসোসিয়েশন এক সভায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, ৭০ মিলিয়ন মানুষের মুক্তি আন্দোলনকে থামানোর জন্য একনায়ক সামরিক বাহিনী দ্বারা যে নির্দয় নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের শাসন চলছে তা উদ্বেগজনক। তারা ভুক্তভোগী মানুষের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক সহানুভূতি এবং সমর্থন প্রকাশ করে। বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির জন্য এই সভায় ভারত সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজের শিক্ষক পরিষদ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কৃষ্ণনগর বার এ্যাসোসিয়েশন পশ্চিম সীমান্তের অন্য দিকের ঘটনার ওপর তার উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং ইয়াহিয়া খান এর সামরিক চক্রের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার নিন্দা জানায়। এটি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপরও যারা কেবল তাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তাদের উপরও পাক-সামরিক বাহিনীর অপরাধের দৃঢ়ভাবে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিন্দা ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য নিন্দা জানিয়েছেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×