ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এশিয়ান তারকারা ঢাকা মাতিয়ে গেলেন

প্রকাশিত: ১২:০৫, ১০ এপ্রিল ২০১৯

এশিয়ান তারকারা ঢাকা মাতিয়ে গেলেন

এশিয়ান ট্যুর গলফ যতবারই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে, ততবারই এর শিরোপা জিতেছেন বিদেশীরা, এদের বেশির ভাগই থাইল্যান্ডের গলফাররা। সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সাদোম কায়েওকাঞ্জনা। ২০ বছর বয়সী এই থাই-গলফারের আগে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ট্যুর চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছেন থিতফুন চুয়ায়প্রাকোং (২০১৬) এবং জায জানেওয়াত্তানানোদ (২০১৭)। অনেকই এই তথ্য জেনে বলতে পারেন থাই গলফারদের জন্য শিরোপা জেতার জন্য বাংলাদেশ হচ্ছে লাকি গ্রাউন্ড! শনিবার ঢাকার সেনানিবাসে অবস্থিত কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে শেষ সমাপ্ত হয় এশিয়ান ট্যুর গলফ-আসর ‘বঙ্গবন্ধু কাপ গলফ ওপেন’। সাদোম পারের চেয়ে ১৯ স্ট্রোক কম খেলে সাদোম চ্যাম্পিয়ন হন। ভারতের অজিতেষ সান্ধু পারের চেয়ে ১৮ স্ট্রোক কম খেলে রানারআপ হন। একই দেশের অপর গলফার রশিদ খান পারের চেয়ে ১৭ স্ট্রোক কম খেলে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। বাংলাদেশের জামাল হোসেন মোল্লা সেরা পেশাদার (প্রফেশনাল) গলফার নির্বাচিত হন। তিনি লাভ করেন দশম স্থান। বাংলাদেশের সেরা এ্যামেচার গলফার নির্বাচিত হন শফিক বাঘা। যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশা ছিল, সেই দেশসেরা তারকা গলফার সিদ্দিকুর রহমান লাভ করেন দ্বাদশ স্থান। বয়স মাত্র ২০। সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ টগবগে তরুণ। যদিও প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এখনও বুঝি কিশোরই আছেন। স্বভাবে বেশ বিনয়ী ও লাজুক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে জেতার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং লড়াকু, সেটা বোঝা গেল শনিবারের শেষ বিকেলে। যখন কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে বঙ্গবন্ধু কাপ গলফ ওপেন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘোষিত হলো তার নামটি, সাদোম কায়েওকাঞ্জনা। পাঠক নিশ্চয়ই বলবেন, নামটা অচেনা, কখনও শোনেননি। হ্যাঁ, ঠিকই। শুনবেনই বা কিভাবে, এর আগে তিনি সিনিয়র পর্যায়ে কোন পেশাদার-আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টই খেলেননি! ঠিক ধরেছেন, জীবনের প্রথম পেশাদার গলফ টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েই বাজিমাত করলেন থাইল্যান্ডের এই সুদর্শন তরুণ-গলফার। তার আরেকটি রেকর্ড আছে। সেটি হলো তিনি ‘ফাস্টেট কোয়ালিফাইং স্কুল গ্র্যাজুয়েট এশিয়ান ট্যুর চ্যাম্পিয়ন’! সাদোম হচ্ছেন তৃতীয় থাই খেলোয়াড়, যিনি বাংলাদেশের মাটি থেকে গলফের শিরোপা জিতলেন। শিরোপাজয়ের পর সাদোম আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে তিনি ট্রফিটা উৎসর্গ করেন তার পরিবারের সদস্যদের। এ্যামেচার গলফার হিসেবে সাদোম ২০১৭ সিংঘা পাতায়া ওপেন, সালে মালয়েশিয়ান ওপেন, অল ইন্ডিয়া এমেচার ওপেন এবং ২০১৮ সালে ডাচ্ ইন্টারন্যাশনাল জুনিয়র ওপেন জেতেন। আগেরদিনই আভাস দিয়েছিলেন, চ্যাম্পিয়ন হতে পারেন সাদোম। কেননা শীর্ষেই ছিলেন তিনি। দিনটা শুরু করেন বেশ ভালমভাবেই। সেটাই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখেন, বাকিরা যেটা পারেননি। অভাবনীয় নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন। সাড়ে তিন লাখ মার্কিন ডলার প্রাইজমানির এই আসরে শিরোপা জিতে তিনি লাভ করেন ৬৩ হাজার ডলার। সাদোম অবশ্য চার বছর আগেও বাংলাদেশে এসে খেলে গিয়েছেন। সেবার তিনি অংশ নিয়েছিলেন ৩০তম বাংলাদেশ এ্যামেচার গলফ চ্যাম্পিয়নশিপে। সেবার রানারআপ হয়েছিলেন তিনি। আর এবার তো চ্যাম্পিয়নই বনে গেলেন! ‘এশিয়ান ট্যুরে অভিষেকেই শিরোপা জিতে আমি ভীষণ খুশি। এ শিরোপা আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেবে। সত্যি বলতে কি, আমার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে এই সাফল্য। তবে জয়টা এত সহজে আসেনি। অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিশেষ করে শেষ তিনটি হোলে খেলতে গিয়ে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, মনোসংযোগ ধরে রাখতে হয়েছে। এই শিরোপাটার জন্য গত তিনটি বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আজ বাবার কথা অনেক মনে পড়ছে। কেননা তিনিই আমার প্রথম গলফ-শিক্ষক।’ এ টুর্নামেন্ট গত ৩ এপ্রিল শুরু হয়। এতে অংশ নেয় ২২ দেশের সেরা ১৪৬ পেশাদার গলফার। এই টুর্নামেন্টের আয়োজক হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশের ৪০ উদীয়মান পেশাদার গলফার এবং ৬ এ্যামেচার গলফার সরাসরি মূলপর্বের খেলায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান। এদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার ও তারকা গলফার সিদ্দিকুর রহমান। এশিয়ান ট্যুর বর্তমান গলফ বিশ্বে গলফের তৃতীয় বৃহত্তম ট্যুর। আন্তর্জাতিক এই টুর্নামেন্টে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে এশিয়ার খ্যাতিমান পেশাদার গলফাররা অংশ নিয়ে থাকেন। নিঃসন্দেহে এই আয়োজন ক্রীড়াবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে। যাঁদের ঘিরে বেশি আশা ছিল প্রথম দিন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খেলেছিলেন জামাল হোসেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডেই নিজের সামর্থ্য দেখান। তৃতীয় রাউন্ডে আবার ছন্দপতন, শেষটা আবার মোটামুটি ভাল করেন। তাতে বঙ্গবন্ধু ওপেনে বাংলাদেশীদের মধ্যে সেরা পারফরমারই হন তিনি। গতবারও বাংলাদেশের সেরা পারফরমার ছিলেন, এবারও তাই কেমন অনুভূতি? জামাল বলেন, ‘শেষটা ভালভাবে করতে পেরেছি, এজন্য ভাল লাগছে। তবে আরও ভাল করার সুযোগ ছিল আমার। সবগুলো রাউন্ড আমি একই রকম খেলতে পারিনি। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে শেষ পর্যন্ত আমি হয়ত শিরোপা লড়াইয়েই থাকতাম।’ বার বার বিদেশীরা শিরোপা জিতে নিয়ে যাচ্ছে, খারাপ লাগে নিশ্চয়? জামালের ভাষ্য, ‘তা তো লাগেই। সত্যি বলতে এবার আমি জেতার জন্যই খেলছিলাম। কিছুদিন আগে ভারতে একটা টুর্নামেন্ট জিতে আমার আত্মবিশ্বাসও ছিল। কিন্তু এখানে দুটি দিন খারাপ করে ফেললাম। শুরুটা ভাল হয়নি, দ্বিতীয় রাউন্ডে বেশ ভাল খেলেছি, তৃতীয় রাউন্ডেও সেটা ধরে রাখার দরকার ছিল, পারিনি। শেষটা ভাল করলাম। আজ তবু প্রত্যাশামতো পাটিং হয়নি, হলে অন্তত ১০ থেকে ১২ আন্ডার থাকত আমার স্কোর।’ প্রতিবারই এখানে বিদেশী তরুণ গলফাররা এসে ভাল করছে, কিন্তু আমাদের তরুণরা সেই চমকটা দেখাতে পারছে না কেন? জামাল বলেন, ‘ধারাবাহিকতার অভাবই মূল কারণ। সাদোম যেমন এক দিনে ৯ আন্ডার খেলেও পারফরম্যান্সটাকে পড়তে দেয়নি। আমরা সেটা পারি না। একটা টুর্নামেন্ট জিততে হলে চারটা রাউন্ডই ভাল খেলতে হয়, নইলে হয় না।’ চাপ-ফিটনেসের অভাবেই কি প্রত্যাশিত ফলাফল হয়নি? ‘চাপ তো থাকেই। নিজের কোর্সে সবাই জিততে চায়। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি হয়তো সেই মানের হয় না। বিদেশীরা যেমন ডায়েট করে, যেমন ট্রেনিং নেয়, সে তুলনায় আমাদের গলফারদের ঘাটতি তো আছেই। এর জন্য কারুর এগিয়ে আসা উচিত। বাইরের দেশে সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতাতেই গলফাররা এগোচ্ছে। আমাদের এখানে সেটা কম। আমি সৌভাগ্যবান, আমার সঙ্গে রানার গ্রুপ আছে, কিন্তু বেশির ভাগেরই তা নেই।’ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ট্যুরের পাঁচটি আসরেই শিরোপা জিতলেন বিদেশী গলফাররা। ২০১৭ সালে সিদ্দিকুর হয়েছিলেন রানার্সআপ। এবারও সবাই তাকিয়ে ছিল সিদ্দিকুরের দিকেই। প্রথম তিন রাউন্ডে পারের চেয়ে ১১ শট কম খেলা সিদ্দিক আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলছিলেন। কিন্তু শনিবার শেষ দিনে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যান। শেষ রাউন্ডে ব্যর্থ হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন দুটি এশিয়ান ট্যুর জয়ী এ গলফার, ‘আমি বলব এটা আমার দুর্ভাগ্য। আমার তিনটা বল গাছের গোড়ায় গিয়ে আটকে যায়। আমি আর কী করতে পারি। সাত নম্বরে, ১৭ নম্বরে গাছের গোড়ায়। হয়ত শেষটা ভাল হয়নি। আর একটা টুর্নামেন্টই শেষ না। সামনে আরও টুর্নামেন্ট আছে। আমি দুঃখিত যে, আপনারা যেটা প্রত্যাশা করেছেন, সেটা পূরণ করতে পারিনি। প্রথম রাউন্ডে ভাল করায় ভেবেছিলাম শেষটা আরও ভাল করব; কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না!’ প্রথম ও তৃতীয় রাউন্ডে হতাশাজনক পারফরম্যান্স করেন জামাল। গত আসরে চতুর্থ হন। এবার দশম। দেশীদের মধ্যে এগিয়ে থাকলেও নিজের পারফরম্যান্সে খুশি নন তিনি, ‘এবারের ফল নিয়ে সন্তুষ্ট নই। নিজের কোর্সে খেলা হচ্ছে বার বার এক-দুই রাউন্ড খারাপ খেলছি। নিজের মাটি থেকে বিদেশীরা জিতে নিয়ে যায়, তা আসলে নিজের কাছে ভাললাগে না।’ দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান ও জামাল হোসেন মোল্লা। ঘরের মাঠের কোর্সে সেরা তিনে কোন বাংলাদেশী থাকতে পারেনি। পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের সুবিধা না পাওয়াকে সামনে এনে আক্ষেপ করেছেন সিদ্দিকুর, ‘আসলে আমার মনে হয়, এখন বলার সময় এসেছে। গলফের জন্য আমরা কী পরিমাণ ট্রেনিং পেয়েছ? আমি যদি বলি ফুটবল, ক্রিকেট, হকি যে পরিমাণ ট্রেনিং পায়, আমরা কি তা পাই? আমি বলব না আমাকে লাখ টাকা দিতে হবে, আমাকে বাজার করে দিতে হবে, বিলাসবহুল বাড়ি দিতে হবে। আসলে বিশ্বমানের পারফরম্যান্স করতে হলে তো ভালমানের ট্রেনিং দরকার, সেই রকম ট্রেনিংটা কি আমরা পেয়েছি? হ্যাঁ, আমি আমাদের কর্মকর্তাদের বিপক্ষে বলছি না। আমার মনে হয়, আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য অনেক কিছুই দরকার। ফিটনেস ট্রেনার, সাইকোলজিস্ট দরকার। এগুলো যত আমরা উচ্চ লেভেলে পাব, তখন আস্তে আস্তে আমরা উন্নতি করতে পারব।’ রিও অলিম্পিকে খেলে আসার পর অনেকটা আড়ালেই ছিলেন সিদ্দিকুর। আগামী ৫০ বছর চেষ্টা করেও অলিম্পিকে স্বর্ণের পদক জেতা অনেক কঠিন বলে মনে করেন তিনি। তাই বলে হাল ছেড়ে দেয়াটা ঠিক নয়, ‘২০২২ টোকিও অলিম্পিক আছে। এখন মনে হয়, আমার সত্যিই ট্রেনিং দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে জার্মানিতে ট্রেনিং করি, সেখানে অনেক ব্যয়বহুল। আমি গত বছরে যে টাকা আয় করেছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ খরচ করেছি। ট্রেনিংগুলো যদি আমরা বাইরে থেকে পাই, তাহলে ভাল খেলার প্রেরণাটা পাব। গলফ ব্যক্তিগত খেলা। এটার জন্য আপনাকে নিজেরও খরচ করতে হবে। কিন্তু ওটার জন্য আপনার সামর্থ্য থাকতে হবে। আমাদের সেটা নেই। আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সবাই জানেন। আমরা যেখান থেকে উঠে এসেছি, সেখান থেকে একজন ইন্টারন্যাশনাল কোচ আনা অনেক কঠিন। প্রত্যেক খেলোয়াড়রই ফিটনেস কোচ, ট্রেনার কোচ ব্যক্তিগতভাবে থাকে। যদি স্পন্সর থাকে, তাহলে তো কথা নেই। যেমন আমার গত তিন-চার বছর যাবত কোন স্পন্সর নেই!’ সিদ্দিকুরের মতো ট্রেনিংয়ের সুযোগ চান জামালও, ‘আমাদের একজন ভাল বিদেশী কোচ দরকার। মেডিটেশন কোচ প্রয়োজন। তখন দেশী-বিদেশী সব জায়গায় ভাল রেজাল্ট করব।’ এখন দেখার বিষয়, গলফ ফেডারেশনের কানে সিদ্দিকুর-জামালের এই কথাগুলো ঢোকে কি-না এবং আগামীতে এই সমস্যাগুলোর সমাধান তারা করতে পারবে কি-না দেখার বিষয়।
×