ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উস্কানির ভুল রাজনীতি এবং বিশ্বশান্তি

প্রকাশিত: ১১:৫২, ১০ এপ্রিল ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উস্কানির ভুল রাজনীতি এবং বিশ্বশান্তি

সিডনির বাংলাদেশী সমাজেও গুরুতর প্রভাব ফেলেছে ক্রাইস্টচার্চের করুণ ঘটনা। প্রতিবাদমুখর এখানকার সুধী সমাজ, সাংবাদিক, লেখকরা এক হয়েছিলেন। তাঁদের মনের ভাষা, চাপা কষ্ট মিলেমিশে একাকার। একটাই চাওয়া বন্ধ হোক এই হানাহানি। ধর্মের নামে উগ্রতার নামে জঙ্গীবাদের নামে এসব নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না হলে মানুষ বাঁচবে কি করে? এই ক্রোধ বা আগ্রাসনের পেছনে যারাই থাকুক, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। নিউজিল্যান্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিবাদ ও সহমর্মিতা কাকে বলে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে সংসদ সর্বত্র যে শিষ্টাচার আর নম্রতা এবং মুসলমান সমাজের জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা, তার প্রতিফলন ঘটুক সব দেশে। তারা সংসদে পবিত্র কোরান পাঠ, একদিন সবাই মিলে হিজাব পরিধানসহ যা যা করেছেন তা তুলনাহীন। পাশাপাশি আমাদের সমাজ আজ এসব ভাবতেও পারে না। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আচরণ বা তাদের কথাই শিরোধার্য। গণতন্ত্রের নামে সর্বজনীন বলে বেশিরভাগ মানুষের কথা শোনার যে প্রবণতা তা সবসময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। আমরা এখনো অন্তর্ঘাতী রাজনীতি থেকে বের হতে পারিনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই সব ধরে রাখেন বলে এখনও নিরাপদ আর ভাল আছে দেশ। যে সব জঙ্গী বা বিপথগামী নানা কারণে দেশ ও মানুষের সর্বনাশ করে তারা কি চোখ খুলে দেখবে ক’জন নিরীহ বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছে নিউজিল্যান্ডে? খুনের বদলা খুন, চোখের বদলে চোখ এমন করতে করতে একসময় অন্ধ পৃথিবী আর মানুষহীন দুনিয়া। এই কি চাই আমরা? সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো এক ছবিতে একটি সিরিয়ান শিশুর একা মরুভূমি পাড়ি দেয়া এখন বিশ্বের টনক নড়ালেও কেউ সমস্যার সমাধান করতে চায় না। এই শিশুটি একা যে দুস্তর মরুভূমি পাড়ি দিচ্ছিল তাতে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল খুব কম। ভাগ্য ভাল জাতিসংঘের কিছু মানুষের চোখে পড়েছিল বাচ্চাটি। তাই এবার প্রাণে বেঁচে গেছে। কিন্তু জানেন কি কি ছিল তার সঙ্গে? তার বগলে বা হাতে রাখা পুঁটলিতে কোন বোমা ছিল না। পিস্তল ছিল না। ছুরিও না। ছিল মা-বোনের কিছু কাপড়। আহা স্মৃতি। হয়তো গৃহযুদ্ধে তারা সবাই আজ মৃত অথবা নিখোঁজ। অসহায় বাচ্চা ঐ কাপড় বুকে নিয়ে জীবন কাটাতে ছুটেছিল জর্দানের পথে। কোথায় মানবতা? কোথায় শান্তি আসলে? দুনিয়ার এখন বড় সমস্যা মিডিয়া একদিকে, সে মানুষকে প্রলোভন আর নানা উপকরণে ভুলিয়ে রাখে; আরেকদিকে মাঝে মাঝে মানবিকতা উস্কে দেবার চেষ্টা করে। সহজ টার্গেট হতে পারত আমাদের দেশও। গুলশান ট্র্যাজেডি সেটাই মনে করিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার সরকার তা রোধ করেছে। উস্কানি আর সর্বনাশের রাজনীতি এখনও আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করছে তার একটা নমুনা বলি। সিডনিতে যারা বিএনপি করেন তাদের সবাই খারাপ সেটা বলা অন্যায়। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনকে জানি যারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সৃজন ঐতিহ্য শক্তি বোঝেন। মানেনও। কিন্তু ভুল রাজনীতির কারণে তারা এমন সব কথাবার্তা বলেন বা উস্কানি দেয় যা বিষতুল্য। আমার এক অনুজপ্রতিম সম্পাদক আমাকে সেদিন বলল, এমন এক বিএনপি নেতা আমার বরাত দিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় উস্কানি ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সে না বললে আমি জানতামও না। কারণ, রাজনীতির নামে কাদা ছোড়াছুড়ির কোন ওয়েব বা হিংসা বিদ্বেষ বিবাদ ছড়ানোর বন্ধু নামের কারও মুখ বই আমি দেখি না। জানলাম তার ভাষ্য মতে, আমি নাকি বলেছি বিএনপির নেতারা সুবেশী কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা লেবাসধারী। অকারণে তিনি সাকা চৌধুরীর মতো একজন মানবতাবিরোধী অপরাধীর কথাও নাকি তুলে এনেছেন। সা কা চৌধুরীর মতো জঘন্য যুদ্ধাপরাধীর নাম আমি উচ্চারণ করতেও ঘৃণা বোধ করি। আমার মতো সব লেবাসধারী নেতার বিরুদ্ধে। তারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে দলেরই হোক না কেন, দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক হলেই আমরা তার বিরুদ্ধে বলব। বলব এই কারণে, আজ সারাদেশে সারা বিশ্বে মৌলবাদের নামে উস্কানিই মূল সমস্যা। নিউজিল্যান্ডের পর যে অস্ট্রেলিয়া বা বাংলাদেশ নিরাপদ তার গ্যারান্টি দেবে কে? রাজনীতির বড় সমস্যা দলবাজি। দেশে গণতন্ত্রের নামে বহু দল থাকবে সেটাই নিয়ম। কিন্তু এই বহু দলে জামায়াত থাকবে কোন কারণে? কি কারণে দেশবিরোধী সমাজবিরোধী আর মানুষ বিরোধী দলগুলো রাজনীতি করবে? গলা ফুলিয়ে শেখ হাসিনা ও প্রগতিবিরোধী কথা বলবে? আমরা এসব কথা বললেই অনেকে মনে করেন আমরা দলকানা। এক চোখ কানা মানুষ কি করে আরেক জনকে দলকানা মনে করেন জানি না। তবে দিনের পর দিন শক্তিহীন আর সাজা পাবার পরও এদের বোধোদয় ঘটেনি। বলছিলাম সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলা দুর্ঘটনার কথা। এই দুর্ঘটনা আমাদের শিখিয়েছে সাবধান হবার বিকল্প নাই। এখন যখন শান্তি ও সহিষ্ণুতা আমাদের কাম্য তখন দেশ ও দেশের বাইরে সতর্ক হবার বিকল্প কোথায়? কোথাও আজ জানমাল নিরাপদ না। যেসব দেশ সভ্য আর উন্নত তারাও আজ অসহায়। সিকিউরিটি বলে যে পদার্থ তা এখন হাস্যকর। মূলত এটা প্রমাণিত মানুষ না চাইলে কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর হয় না। এবং কোন যন্ত্রের সাধ্য নেই তা পালন করে দেখায়। তাই মানুষকেই জাগতে হবে। সভ্যতার একটা বড় সুফল বোধ। এই বোধ যদি কাজ না করে তাহলে কোন দেশের মানুষ নিরাপদ থাকবে না। সমস্যা হলো আমাদের সমাজ সে বোধ হারাতে চলেছে। নানা উস্কানি আর প্রলোভন অন্যদিকে ভুল রাজনীতি তাকে যেন বিপদে ফেলতে না পারে। সিডনির বাংলাদেশী সমাজ সন্ত্রাস আর হত্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন বিশ্বের সাধারণ মানুষও। সে কারণেই ঐক্য গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যার বড় প্রমাণ এ দেশের এক রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে রেকর্ড পরিমাণ সাইন করা প্রতিবাদ। শ্বেতাঙ্গরা তাদের দিল খোলা ভালবাসা আর সমর্থন জানাতে কার্পণ্য করেননি। আমাদের চোখে হিরো হয়ে ওঠা ডিমবয়কে ভোলা যাবে? মুসলমান না হয়েও তাদের প্রতি ভালবাসা আর হত্যা নারকীয়তার প্রতিবাদে ঝুঁকি নেয়া এই যুবককে স্যালুট জানানোর পাশাপাশি আমাদের যুবকদের ভেতরও যেন এই প্রবণতা জেগে ওঠে। যুবশক্তি না জাগলে কি আমরা দেশ ও সমাজকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে পারব? না পারব আরাধ্য গন্তব্যে পৌঁছুতে? বিশ্ববাঙালীর নিরাপত্তাও আজ হুমকির মুখে। মানুষে মানুষে শুভবোধ আর ভালবাসা গড়ে উঠুক। নিরাপদ হোক এই পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথের সে বাণী যেন ভুলে না যাই আমরা- মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সে বিশ্বাসই যেন বড় করে তোলে আমাদের। [email protected]
×