ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ সাপোর্টেই নুসরাতের অস্ত্রোপচার

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১০ এপ্রিল ২০১৯

লাইফ সাপোর্টেই নুসরাতের অস্ত্রোপচার

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ফেনীর সোনাগাজীতে আগুনে ঝলসে দেয়া সেই শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি (২০) অল্প অল্প শ্বাস নিচ্ছে। এখনও সে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এদিকে মঙ্গলবার সকালে লাইফ সাপোর্টে রেখেই অস্ত্রোপচার হয়েছে। ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ থাকায় ওই ছাত্রীকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে চারদিনেও পুলিশ আগুন দেয়া হাত মোজা ও চোখে চশমাসহ বোরকা পরা চারজনকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা মামলায় চার আসামিকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে সোনাগাজী থানা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভেন্টিলেশনে (লাইফ সাপোর্ট) রেখেই মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থী নুসরাতের অস্ত্রোপচার হয়েছে। সকাল সোয়া ১০টা থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী এ অস্ত্রোপচার চলে। চিকিৎসকরা জানান, তার ফুসফুস সক্রিয় করতে এ অস্ত্রোপচার হয়েছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে এই অস্ত্রোপচার হয়েছে। বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, মেয়েটি শ্বাস নিতে পারছিল না। যেন একটু শ্বাস নিতে পারে, সেই জন্য তার এই অস্ত্রোপচার করা হলো। এখন সে শ্বাস নিতে পারবে। ডাঃ নাসির বলেন, গতকালই (সোমবার) আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করতে পারিনি। আজ (মঙ্গলবার) সকালে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদেরও একই পরামর্শ ছিল। শরীরের কোন অংশ পুড়ে গেলে চামড়া শক্ত হয়ে যায়। হাত পায়ে হলে এটি নড়ানো যায় না। বুকে হলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই মেয়েটির যেন শ্বাস নিতে সুবিধা হয়, সেই জন্য অস্ত্রোপচার করা হলো। তিনি বলেন, এখনও ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর আগে সকালে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকদের ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়। ভিডিও কনফারেন্স শেষে বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের জানান, সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে আগুনে ঝলছে যাওয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী একটু শ্বাস নিতে পারে, সেই জন্য তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় নুসরাতের সর্বশেষ অবস্থা কি? এ প্রসঙ্গে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জনকণ্ঠকে জানান, সকালের যে অবস্থা আপনাদের জানানো হয়েছে। এখন ঠিক একই অবস্থা। অল্প অল্প শ্বাস নিচ্ছে। তার অবস্থা কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অগ্নিদগ্ধ মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো যাচ্ছে না ॥ সারা দেহে পোড়া ক্ষত নিয়ে লাইফসাপোর্টে থাকা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে এখনই সিঙ্গাপুরে পাঠানো সম্ভব নয়। মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন এ কথা জানান। তিনি জানান, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়েছে। তারা বলেছে, রোগীর যে কন্ডিশন, তাতে পাঁচ ঘণ্টা ফ্লাই করা সম্ভব নয়। তারা আমাদের কিছু সাজেশন দিয়েছে। কী কী করা লাগবে। আমরা সেগুলো করছি। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সব করা হচ্ছে জানিয়ে ডাঃ সামন্ত লাল জানান, প্রতিদিন আমরা রিপোর্টেগুলো জানাব। অবস্থার উন্নতি হলে চিন্তা করব ট্রান্সফার করার। তিনি জানান, ওই মাদ্রাসাছাত্রীকে স্কারোটমি (বংপযধৎধঃড়সু) করা হয়েছে। এটি করায় এখন সে শ্বাস নিতে পারবে। ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, ১৭ এপ্রিল সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের একটি চিকিৎসক দল ঢাকা আসবে। তখন তারা নুসরাতকে দেখে মতামত দিতে পারবে। তিনি জানান, আমরা সকালে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এই অস্ত্রোপচার করেছি। নুসরাতের চিকিৎসায় ৯ সদস্য বিশিষ্ট গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ডাঃ আবুল কালাম জানান, নুসরাতের চিকিৎসার আপডেট রিপোর্ট নিয়মিত সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। তিনি জানান, আজকের অপারেশনটা গতকাল করার কথা ছিল। যেহেতু ওর অবস্থার অবনতি হয় তাই আমরা ভেন্টিলেশনে নিয়ে আজ (মঙ্গলবার) অপারেশন করি। তার পরিবারও আমাদের সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে একমত হয়েছেন। আমার মেয়ে বাঁচবে তো ॥ মেয়ের কি হবে? এই চিন্তায় ঘুমাতে পারছে না তার বাবা ও মা। তাদের চোখে ঘুম নেই। বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেন্ডেন্সি সেন্টারে বারান্দায় শুয়ে বসে হেঁটে কাটাচ্ছে। কোনভাবেই স্বস্তি পাচ্ছে না। একবার বসছেন, একটু পর হেঁটে সামনে থেকে কয়েক মিনিট ঘুরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছেন। কখনও এগিয়ে গিয়ে মেয়ের খবর নিয়ে আসছেন। মঙ্গলবার ভোরে বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) বারান্দায় সারারাত শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন মেয়েটির মা। তিনি বলেন, চোখ বন্ধ কিন্তু ঘুমাননি। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মেয়েটির সুস্থতা কামনায় দোয়া করছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ঘুমানোর চেষ্টা করলেও পারছেন না। শুধু চোখ বন্ধ করে থাকছেন। আইসিইউ থেকে ডাকলেই উঠে বসছেন। এদিকে তাকে সান্ত¡না দিতে স্বজনরা কেউ কেউ তার পাশে বসে আছেন। তারা জানান, কথা বলার মতো শক্তিও যেন নাই তার মায়ের। আইসিইউয়ের সামনে দাঁড়ালেই কেঁদে ফেলেন নিমিষেই। কেঁদেই সবার কাছে মেয়ের জন্য দোয়া চান তিনি। সেখানে বসে-দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছেন মেয়েটির বাবা। মেয়েটার কী হয় না হয় সেই ভয় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা মামলায় এজাহার পরিবর্তন ॥ ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা মামলায় এজাহার পরিবর্তন করে অধ্যক্ষসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পুলিশ এখনও পর্যন্ত বোরকা পরা চারজনকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোনাগাজী থানার পরিদর্শক মোঃ কামাল হোসেন জানান, সোমবার রাতে নতুন এজাহারে আসামিরা হচ্ছেন, অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, সাবেক ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের। পরিদর্শক কামাল জানান, এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও প্রভাষক আবছার উদ্দিনের নাম এজাহারে হয়েছে। অন্য পাঁচজনের নাম এজাহারে নেই। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এজাহারের অন্য ছয় আসামিকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। এদিকে পুলিশ হাতে মোজা ও চোখে চশমাসহ বোরকা পরা আরও চারজনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সোনাগাজী থানার ওসি মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পুলিশ এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। ইতোপূর্বে আটক শিক্ষক আফসার উদ্দিন ও আলীম পরীক্ষার্থী আরিফুর রহমানকে ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠালে আদালত তাদের জেল হাজাতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। তাদেরও এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। ওসি জানান, এজহারভুক্ত ছয় আসামি ও বোরকা পরা চারজনকে গ্রেফতার করতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওয়তায় আনা হবে। ৪ আসামি আসামি রিমান্ডে ॥ আমাদের ফেনীর নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের হেফাজতের (রিমান্ড) আদেশ দিয়েছে আদালত। আদালত পুলিশের পরিদর্শক গোলাম জিলানি জানান, ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরীফ উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে এ আদেশ দেন। রিমান্ডে দেয়া চার আসামি হচ্ছেন, আলাউদ্দিন, কেফায়েত উল্লাহ, নূর হোসেন ও শহীদুল ইসলাম। এ মামলায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি তিনজন আদালতে হাজির না থাকায় রিমান্ড শুনানি হয়নি বলে জানান জিলানি। এর আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আটক ৭ জনকে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের রেঞ্জের ডিআইজি খোন্দকার গোলাম ফারুক সোনাগাজীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন । তিনি দোষী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান। এ ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। ঘটনার মূল হোতাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে অভিভাবক শিক্ষার্থী ও সচেতন মহল। নুসরাতের বাড়িতে পুলিশ ॥ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন জানান, মঙ্গলবার বিকেলে নুসরাতের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে তার পড়ার টেবিলসহ কয়েকটি স্থানে তল্লাশি চালিয়েছে। এ সময় তারা দুইটি চিরকুট উদ্ধার করেছেন। কামাল বলেন, চিরকুট দুটিতে নুসরাত অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। অধ্যক্ষ বিভিন্ন সময় তাকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেয়া, এর বিনিময়ে পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, অশ্লীল আচরণ করার অভিযোগ করেন। এসব ঘটনার বিচারও চেয়েছেন। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে ফেনী সোনাগাজীতে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে নারী সংগঠন। অপরদিকে ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধনে কর্মজীবী নারী সংগঠনের সভাপতি সালেহা বেগমসহ নারীনেত্রীরা বক্তব্য দেন। এ ঘটনায় তারা আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
×