ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চৈত্র মাসে বর্ষাকাল ॥ প্রকৃতির বৈরী আচরণ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ১০ এপ্রিল ২০১৯

চৈত্র মাসে বর্ষাকাল ॥ প্রকৃতির বৈরী আচরণ

শাহীন রহমান ॥ এবার আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি বুঝে ওঠা দায় হয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে তার চরিত্র। আচরণ করছে বিচিত্র ধরনের। আবহাওয়ার এই ধরন দেখে বোঝায় উপায় নেই প্রকৃতিতে এখন কোন্ ঋতু বিরাজ করছে। বৈশাখ এখনও না এলেও প্রায় প্রতিদিনই সকাল-বিকেল বয়ে যাচ্ছে বৈশাখী ঝড়। এতে গাছপালা ও ঘরবাড়ির যেমন ক্ষতি হচ্ছে আবার বজ্রপাতে প্রায় প্রতিদিন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আবার ভারি বৃষ্টিপাতের পর শীতল আবহাওয়ায় মনে হচ্ছে প্রকৃতিতে এখন শীত ঋতু। কিছুক্ষণের মধ্যে আবহাওয়া বদলে রৌদ্রে খরতাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষ গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। খোদ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন ধরেই বিচিত্র এই আবহাওয়া বিরাজ করছে। মঙ্গলবার সকালের শুরুটা ছিল অন্যদিনের মতোই। পরিষ্কার আবহাওয়া, রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ। আকাশ পরিষ্কার, কোন মেঘ নেই। অবস্থা দেখে বোঝার উপায় ছিল না এখনই মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামতে পারে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগেনি। সাড়ে ১০টা বাজতেই মুহূর্তেই চারদিকে অন্ধকার। মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির ধরন দেখেও বোঝার উপায় ছিল না প্রকৃতিতে এখন আষাঢ় না বসন্ত চলছে। কিছুক্ষণ পরেই আবহাওয়ার আবারও পরিবর্তন। চারদিকে রৌদ্রোঝলমলে পরিবেশ। এবার প্রকৃতি দেখে বোঝার উপায় নেই যে কিছুক্ষণ আগেই মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি এসেছিল। এমনকি এদিন বিকেলে পরিবেশও জানান দেয়নি কালবৈশাখী আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বৈশাখ শুরু হওয়ার আগে প্রকৃতি এবার বিচিত্র ধরনের আচরণ করছে। কখনও মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামছে। আবার কখনও শুরু হচ্ছে কালবৈশাখী। আবার রৌদ্র বাড়লে ভ্যাপসা গরমে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। ভারি বৃষ্টিপাতের পরই বয়ে যাচ্ছে শীতল অনুভূতি। মনে হচ্ছে প্রকৃতিতে এখন বয়ে যাচ্ছে শীতের কোন সকাল। বিচিত্র ধরনের এই আবহাওয়ার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। নদীগুলোতে নৌচলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আবার কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাতের কারণে কৃষকের মাঠে কাজ করা দায় হয়ে পড়ছে। তারা বুঝে উঠতে পারছে না কখন বৃষ্টি অথবা কালবৈখাশী ঝড় আসতে পারে। না বুঝে মাঠে কাজে গিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মঙ্গলবার সিলেটে মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে তিন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে নৌ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় নদীবন্দরগুলোত নৌযান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার ঝড়োহাওয়ার কারণে সন্ধ্যায় কাঁঠালবাড়ি শিমুলিয়া নৌরুটে নৌচলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এমনকি মাঝনদীতে থাকা নৌযানগুলোকে নদীর বিভিন্নস্থানে নোঙ্গর করে রাখতে বলা হয়। শুধু মঙ্গলবারের কালবৈশাখীর ঝড় নয়। প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। গত চার এপ্রিল বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে নৌরুটে দুর্ঘটনা এড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে বাংলা বৈশাখ মাস। বৈশাখ মাসের চরিত্র হলো ঝড়োহাওয়া, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রঝড়। কিন্তু এবার বৈশাখ শুরু হওয়ার আগেই দেশের বিভিন্নস্থানে বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী। কালবৈশাখী প্রভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে মৃত্যরল ঘটনা ঘটছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ওপর দিয়ে পশ্চিমা লঘুচাপ এবং বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা বায়ুপ্রবাহের সংমিশ্রণেই আবহাওয়ার এই বিচিত্র আচরণ শুরু হয়েছে। তারা বলেন, এতে করে বাতাসে জলীয়কণার পরিমাণ যখন বেশি পরিমাণে বাড়ছে তখন প্রচ- গরমের অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে কালশৈাখীর সূত্রপাত ঘটছে। আবার যখন ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে তখন তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতল অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলেন, আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই অবস্থা থাকতে পারে। এর পরে আবার দেশের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে। এই অবস্থার কারণে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা থাকবে। এর পর এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে জানান আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ। এদিকে আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণের কারণে প্রায় প্রতিদিনই কালবৈশাখীর সতর্ক সংকেত দিচ্ছে আবহাওয়া অফিস। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তারা এই সতর্কতা জারি অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার বিকেলে সারাদেশে এই ধরনের সতর্কতা জারি করে আবহাওয়ার বিশেষ সতর্কতায় উল্লেখ করা হয় রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের ওপর দিয়ে দমকা, ঝড়োহাওয়া, বজ্রসহ বৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তাদের এই সতর্কতার পর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় কালবৈশাখীর আঘাত হানার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়ার এমন আচরণ সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, দুই ধরনের বায়ু সংমিশ্রণের কারণেই বিরূপ আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বাতাসে জলীয়কণার যোগান বাড়ছে। ফলে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত এই বিরূপ আবহওয়া বিরাজ করবে। এই সমরেয় মধ্যে কখনও কালবৈশাখী বয়ে যাবে। আবার বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিও হবে। আবার জলীয়কণার যোগান বাড়লে ভ্যাপসা গরম অনুভূতি তৈরি হবে। তিনি বলেন, মধ্য এপ্রিলের পড় থেকে তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করবে। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন্স্থানে তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে। তবে এই মাসে সাগরে নি¤œচাপ- ঘূর্ণিঝড়ের কোন আশঙ্কা নেই। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বায়ুর সংমিশ্রণের কারণে দেশের ওপর দিয়ে বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করছে। এর কারণেই মূলত কখনও বজ্রমেঘের সৃষ্টি, কখনও ঝড়ো হাওয়া আবার কখনও ভারি বৃষ্টিপাত আবার কখনও ভ্যাপসা গরমের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এদিকে এক সপ্তাহ ধরেই বিরূপ আহাওয়ার কারণে রাজধানী একাধিকবার বৈশাখীঝড় ও ভারি বৃষ্টিপাতের কবলে পড়েছে। সোমবার সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকায় ভারি বৃষ্টিপাত ও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। পরদিন মঙ্গলবারও কালবৈশাখী ও ভারি বৃষ্টিপাতের দেখা মেলে। সোমবারের বৃষ্টিপাত ও কালবৈশাখীর কারণে বিভিন্নস্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পথচারী এবং অফিসফেরা লোকজন চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে যায়। এদিনে রাজধানীতে প্রচ- ঝড়োবাতাসের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতে নগরীর অনেক সড়কই তলিয়ে যায়। বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে উপড়ে পড়ে বিশাল একটি গাছ। গাড়ির ওপর আছড়ে পড়লেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান এর আরোহীরা। সোমবার সকাল থেকে কোথাও কোথাও আকাশ ছিল অনেকটা মেঘলা, তবে বৃষ্টির খবর ছিল না। কিন্তু, বিকেল গড়াতেই ঢাকার আকাশ-বাতাস ভারি করে চৈত্রের শেষ ও বৈশাখের আগমনী বার্তা জানাতে নামে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। প্রথমে একপসলা, এর কিছুক্ষণ পর শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বিদ্যুত চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার। কোথাও কোন মেঘের দেখা ছিল না। কিন্তু এই অবস্থা পাল্টাতে বেশি সময় লাগেনি। সাড়ে ১০টায় চারদিক অন্ধকার করে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টিপাত। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল আষাঢ়ের বর্ষণ চলছে প্রকৃতিতে। একনাগারে বৃষ্টিপাত হতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। একঘণ্টা পরই পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় ছিল না ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে কিনা। বেলা গড়াতে আবারও মেঘ কেটে যায়। আকাশ পরিষ্কার হয়ে পড়ে। বিকেলেরদিকে শীতল বাতাস বইতে শুরু করে। মেঘ ছিল পরিষ্কার। কিন্ত সন্ধ্যা নামতে পরিবেশে আবার পরিবর্তন। শুরু হয় প্রচ- ঝড় আর কালবৈশাখীর তা-ব। এ সময় শিলাবৃষ্টি হতে দেখা গেছে। কিছুক্ষণ পরই আবার পরিস্থিতি শান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘরেফেরা মানুষের এজন্য কোন প্রস্তুতি ছিল না। পথেই তারা কাকভেজা হয়ে পড়েন। আগাম কোন সতর্কতা ছাড়াই গত ৩১ মার্চ থেকে দেশের বিভিন্নস্থানের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কালবৈশাখী। প্রথম আঘাতে দেশের বিভিন্নস্থানে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। খোদ রাজধানীতে গাছ উপড়ে দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। নৌকাডুবিতে ৭ জনের মৃত্যু হয়। ওই দিনের ঝড়ের তা-ব এত বেশি ছিল যে বিদ্যুত গ্রিড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গাছ উপড়ে এবং ডাল ভেঙ্গে প্রাইভেট কার সিএনজি চাপা পড়ে। যানচলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। প্রচ- বাতাসে রাজধানীসহ দেশের অনেকস্থানে বহুতল ভবন কেঁপে ওঠে। রাজধানীর হাতিরঝিল, কামরাঙ্গীরচরের সোনামুড়া ঘাট, সোনারগাঁও এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এদিকে ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
×