ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দগ্ধ নুসরাতের শেষ কথা

‘আমার যা হয় হোক, ওদের যেন বিচার হয়’

প্রকাশিত: ১১:০৫, ৯ এপ্রিল ২০১৯

‘আমার যা হয় হোক, ওদের যেন বিচার হয়’

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ভাই আমার যা কিছু হয় হোক, তবুও ওদের যেন বিচার হয়। ফেনীতে আগুনে ঝলসে দেয়া সেই মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি (২০) কথা বলছিল ভাই রাশেদুলের কাছে। পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টাকারীদের বিচার দাবিতে ওই ছাত্রী যখন বারবার কথাগুলো বলছিল তখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এরপরই চিকিৎসকরা দ্রুত তাকে লাইফ সাপোর্টে নেন। এদিকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নুসরাত দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এক চিকিৎসকের কাছে বলে, দুই নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরা চারজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই চারজনের একজনের নাম ছিল শম্পা। অন্যদিকে দগ্ধ ছাত্রীকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনদিন পর ফেনীর সোনাগাজী থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এখনও মূল হোতাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দগ্ধ ছাত্রীর ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আজ (সোমবার) সকাল সাড়ে নয়টায় আমি ও আমার মা ওকে আইসিইউতে দেখতে যাই। কষ্ট ও যন্ত্রণায় ও তখন বারবার বলছিল, ভাই আমার যা হয় হোক প্রিন্সিপাল সিরাজ উদদৌলা ও তার সহযোগী, যারা আমার গায়ে আগুন দিয়েছে তাদের যেন বিচার হয়। শোন ভাই, আমি বুঝতে পারছি- মনে হয় আর বাঁচব না। যদি আমার কিছু একটা হয়ে যায়, মাকে খেয়াল রাখবি। ভাই, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বাঁচাও.. প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাও। কথাগুলো বলার সময় ওর শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। এরপর আর কোন কথা বলতে পারেনি। এরপরই চিকিৎসকরা দ্রুত ওকে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দগ্ধ ছাত্রীর বক্তব্য ॥ যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আগুনে ঝলসে দেয়ায় সেই শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি মৃত্যু শয্যায় এক চিকিৎসককে বলেন, নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পচারজন তার গায়ে আগুন ধয়ে দেয়। ওই চারজনের একজনের নাম ছিল শম্পা। দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওই ছাত্রী একজন চিকের কাছে বক্তব্য দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মুমূর্ষু রোগীদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য নেয়া হয়। যা পরবর্তীতেআদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হ। ওই ছত্রী জানায়, ঘটনার দিন শনিবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রে তার ভাইকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। কেন্দ্রে ঢোকার পর একটা সময় তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়হয়। ছাদের ওঠার পর সে নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পহিত চারজনকে দেখতে পায়। তাদের মধ্যে মূলত কথা বল একজন। সে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এ কথা বলতে চাপ দেয়। সে এতে অস্বীকৃজানালে ওই চারজন ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে। তার গয়ে ওরা কিছু একটা ছুড়ে দেয়। তারপর বলে, যা এবার পালা। গায়ে আগুন লাগা অবস্থাতেই সে দৌড়ে পালায়। চারজনের কেউ কারও নাম উচ্চারণ না করলেও কোনো একপর্যায়ে একজন শম্পা বলে একজনকে ডাকে। সে যে কণ্ঠ শুনেছে, তা নারীকণ্ঠ। তবে মুখ ঢাকা থাকায় কাউকে চিনতে পারে। অগ্নিদগ্ধ ওই ছাত্রী বলে, ওড়নাটা ছাই হয়ে যাওয়ার পর হাতের বাঁধন খুলে যায়। ওই ছাত্রী জানায়, কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নারী শিক্ষার্থীদের হয়রাকরে আসছেন। তিপরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখাতেন। তার কথায় রানা হলে তিনি হেনস্থা করতেন। আগে এ বিষয়ে পারকে না জানালেও গত ২৭ মার্চ তার সঙ্গে অধ্যক্ষ অশোভন আচরণ করেন। বিষয়টি ওই শিক্ষার্থী পকে জানায়, মাদ্রাসার অন্য শিক্ষার্থীদেরও জানায়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর থেকে সে ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় যাচ্ছিল। পরে ওই ছাত্রীর কথাগুলো রেকর্ড করে রাখা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। লাইফ সাপোর্টে নুসরাত ॥ সোমবার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, মেয়েটির অবস্থা ভাল না। সকালে তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ দিকে চলে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। আমরা তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জাহান রাফিকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। ৯ সদস্যের চিকিৎসক বোর্ডে প্রধান জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম জানান, মেয়েটির অবস্থা ভাল না। তার ফুসফুস ঠিকভাবে কাজ করছে না। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাই তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর ॥ ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউ চিকিৎসাধীন সেই ছাত্রীকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার নির্দেশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী সচিব ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া তাকে দেখতে বার্ন ইউনিটে আসেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। তাকে দেখে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডাঃ সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। ওনাকে ওই ছাত্রীর অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছি। পরে তিনি নির্দেশ দেন দগ্ধ ছাত্রীর উন্নত চিকিৎসা জন্য সিঙ্গাপুরে কথা বলতে, যদি ওনারা ওই ছাত্রীকে নিতে রাজি হন, দ্রুত তাকে সেখানে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি এখানে এসেছি। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচার হবেই। তবে প্রধানমন্ত্রী ওই ছাত্রীর উন্নত চিকিৎসার সিঙ্গাপুরে পাঠানো নির্দেশ দিয়েছেন। পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় মামলা ॥ আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রীকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে সোনগাজী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। সোমবার বিকেলে বাদী মামলায় চারজন অজ্ঞাত বোরকা পরা মহিলাসহ শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগকারী কয়েকজন অজ্ঞাতনামা আসামি বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন। তবে মামলায় আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। সোমবার দুপুরে পুলিশ সন্দেহভাজন আরও তিনজনকে আটক করেছে। এ নিয়ে এই মামলায় ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। মামলার তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তাদের নাম পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে অপর একটি সূত্র জানায়, আটককৃতদের মধ্যে মাদ্রাসার নিরাপত্তা প্রহরী মোঃ মোস্তফা ও পিয়ন নুরুল আমিন রয়েছে। এর আগে পুলিশের কাছে আটক থাকা মাদ্রাসার শিক্ষক আফসার উদ্দিন ও আলীম পরীক্ষার্থী আরিফকে ৫৪ ধারায় সোমবার সকালে আদালতে প্রেরণ করেছে সোনাগাজী থানা পুলিশ। বিকেলে সোনাগাজীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরফ উদ্দিনের আদালতে তাদের হাজির করা হলে আদালতের বিচারক তাদের জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ইতোপূর্বে আটককৃতদের ৫৪ ধারায় আদালাতে পাঠালেও এ মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হবে। কারণ এদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটি ॥ ফেনী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) পিকেএম এনামুল করিম জানান, এ ঘটনায় ফেনী জেলা প্রশাসনের নির্দেশে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিকে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। মাদ্রাসার তহবিল থেকে নুসরাতের চিকিৎসার জন্য অনুদানে দুই লাখ টাকার চেক সোমবার দুপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) পিকেএম এনামুল করিম নুসরাতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। একই হলের আলীম পরীক্ষার্থী আবু বকর ছিদ্দিক জানান, নুসরাত আগুন নিয়ে ভবনের ছাদ থেকে নিচে নেমে আসার পার তিনি নুসরাতের গায়ের আগুন নেভাতে চেষ্টা করেন। আগুনে নুসরাতের কাপড় পুড়ে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে গেলে তিনি তার গায়ের পাঞ্জাবি খুলে নুসরাতের গায়ের ওপর দেন। পাশের হোস্টেল থেকে ৪টি লুঙ্গি আনিয়ে নুসরাতের শরীর ঢেকে দেন। পরে নুসরাতকে কর্তব্যরত পুলিশের সহায়তায় সিএনজি অটোরিক্সা তুলে দিয়ে তিনি পরীক্ষা দিতে যান। এদিকে এলাকাবাসী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে। জনপ্রতিনিধি সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন, সোনাগাজী এলাকার সকল জনপ্রতিনিনিধিসহ এলাকাবাসী এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত বিচার দাবি করছে। হত্যাচেষ্টার সন্দেহের তীর ৪ শিক্ষার্থীর দিকে ॥ ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় চার শিক্ষার্থীকে সন্দেহ করছে দগ্ধ ছাত্রীর পরিবার সদস্যরা। এই সন্দেহভাজনরা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে ওই ছাত্রীর পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল। সন্দেহভাজন চার মাদ্রাসা ছাত্র হচ্ছে নূরউদ্দিন, শামীম, জাভেদ ও মহিউদ্দিন শাকিল। তারা সবাই সোনাগাজী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। সোমবার দুপুরে দগ্ধ ছাত্রীর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে দায়ের করা যৌন হয়রানির মামলাটি তুলে নিতে মাদ্রাসার এই চার ছাত্র হুমকি দিয়ে আসছিল। এরা অধ্যক্ষের পেটোয়া বাহিনী। আমি এই চারজনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা করেছি। নোমান বলেন, আমার বোনকে তারা হত্যার চেষ্টা করেছিল। তারা বোরকা পরে মেয়ে সেজে এই কাজ করেছে। ঘটনার পর আমার বোনও মুখোশ এবং বোরকা পরা ব্যক্তিদের কথা বলেছিল। এরাই তারা।
×