ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় অভিভাবকদের উদ্বেগ

রাবিতে মাদকের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ৯ এপ্রিল ২০১৯

রাবিতে মাদকের ছড়াছড়ি

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ সহজলভ্য হওয়ায় রাজশাহীতে এখন মাদকের অবাধ বাণিজ্য চলছে। রাজশাহী নগরী ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের অভয়ারণ্য। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হচ্ছে সর্বগ্রাসী মাদকে। অকালে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। সর্বশেষ রবিবার মাদকের বিষক্রিয়ায় রাবির দুই ছাত্রের মৃত্যুর পর এ নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষক শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা মাদকমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি তুলেছেন। এ ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসনই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাবিতে দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় প্রথমদিন নগরীর এক ফার্মেসির মালিকসহ আটক তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হলেও রবিবার দিবাগত রাতে নতুন করে আরও তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। এদিকে এ ঘটনায় রবিবার রাতে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। বোয়ালিয়া থানার ওসি আমানুল্লাহ আমান বলেন, দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে আটক করা হয়েছে। এরা হলেন, রাজপাড়া থানার সিপাইপাড়া এলাকার আব্দুর রউফের ছেলে ইফতেখায়ের হোসেন সুমন। কাশিয়াডাঙ্গা কোর্ট বরসি এলাকার মৃত হোসেন আলীর ছেলে লুৎফর রহমান ও বোয়ালিয়া বড়কুঠি এলাকার বাচ্চু শেখের ছেলে জনি শেখ শুভ। এদিকে রবিবার রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই ছাত্রের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এতে তাদের শরীরে বিষক্রিয়ার প্রমাণ মিলেছে। ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিবারের কাছে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঈশ্বরদীর রূপপুরে কর্মরত রাশিয়ান কোম্পানির প্রকৌশলী বেলি দিমিত্রীর লাশের ময়নাতদন্ত শেষে কোম্পানির মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া রূপপুরে মাদকের বিষক্রিয়ার অসুস্থ অপর দুইজনকে রবিবারেই রাজশাহী থেকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক লায়লা আরজুমান বানু বলেন, মদপানের কারণে দুই শিক্ষার্থীর শরীরে এ বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। একই ঘটনায় রুয়েটের রাকিব আহমেদ রকি নামে এক শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে আইন বিভাগের মুহতাসিম খুলনার দৌলতপুর উপজেলার কবির আলমের ছেলে। অপরজন অর্থনীতি বিভাগের তূর্য রায় নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ছোট রাউতরা গ্রামের পুর্নেন্দ্র রায়ের ছেলে। তারা দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাবির দুই ছাত্র গাঁজা, ইয়াবা ও এ্যালকোহলের মিশ্রণ ঘটিয়ে একসঙ্গে পান করায় তাদের মৃত্যু হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এছাড়া রূপপুরে কর্মরত রাশিয়ান প্রকৌশলীর মৃৃত্যুও মদের বিষক্রিয়ায় হয়েছে। বেলি দিমিত্রী পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। অতিরিক্ত মদপানের কারণে বিষক্রিয়ায় তিনি মারা গেছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এদিকে রাবির দুই ছাত্রের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর উপরভদ্রা এলাকার সাঈদ টাওয়ারে অবস্থিত মেসে তূর্য থাকতেন। শুক্রবার রাতে তিনি তার দুই বন্ধুকে সেখানে ডাকেন। তারা তিনজন ইয়াবা, গাঁজা ও পানির সঙ্গে এ্যালকোহল মিশিয়ে একসঙ্গে পান করেন। এরপর থেকেই তাদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাদের এক সহকর্মী সাংবাদিকদের জানান, শনিবার রাত ১০টার দিকে রাফিদ তাকে ফোন করে মদপানের কারণে তাদের অসুস্থতার কথা জানান। তোহরাব তাদের হাসপাতালে নিতে চাইলে তারা হাসপাতালে না যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ৩টার দিকে তারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তোহরাব তাদের রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে রাতে রাফিদ এবং সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তূর্য রায় মারা যান। এদিকে, শনিবার বিকেলে বেলি দিমিত্রীসহ পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর প্রকল্পে কর্মরত চার প্রকৌশলী মদপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় তাদের ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদের রামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালে আনা হলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক দিমিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন। রামেক হাসপাতালের চিকিৎসক নাফিস রহমান বলেন, হাসপাতালে পৌঁছার আগেই দিমিত্রীর মৃত্যু হয়। বাকি তিনজনের মধ্যে দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এখন তারা ঢাকায় চিকিৎসাধীন। রাজশাহী মহানগরের রাজপাড়া থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, আলাদা ঘটনায় মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে দুই ছাত্রের লাশ রাবি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিবারের কাছে এবং রাশিয়ান প্রকৌশলীর লাশ রূপপুর প্রকল্পে নিয়োজিত কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাবিতে মাদকের বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ ॥ এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বেড়েছে মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বারবার মাদকবিরোধী অভিযান থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে চলছে অবাধে মাদক ব্যবহার। মাদকাসক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ মদপান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মুহতাসিম রাফিদ খান ও রবিবার সকালে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তূর্য রায় মারা যান। তাদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্যাম্পাসে অবাধে মাদক ব্যবসা ও সেবনের বিষয়টি ফের সামনে উঠে এেেসছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্যাম্পাসের নানা পয়েন্টে অবাধে চলছে মাদক সেবন। সন্ধ্যা নামলে নির্জন জায়গাগুলোতে এবং হলের কক্ষগুলোতে মাদকের আসর বসাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের জায়গায় মাদক সহজলভ্য হওয়ায় সহজেই শিক্ষার্থীরা এসব মাদক সেবন করতে পারছে। তাদের মাদক যোগান দিচ্ছে স্থানীয় মাদক কারবারিরা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টোরিয়াল বডি মাদক সেবন নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফা অভিযান চালালেও তা কাজে আসছে না। পুলিশের ধরপাকড় ঠা-া হলে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ীরা। এছাড়া হলে হলে যেসব মাদকের আসর বসছে তা সমাধানে পদক্ষেপ নিচ্ছে না হলো প্রশাসন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষার্থীরা একাডেমিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকের দিকে ঝুঁকছে। একে তো মাদক সহজলভ্য হয়ে গেছে, তার ওপর তাদের তদারকি করার কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা দফতর গুলোর খোঁজ খবর রাখলে এমন প্রাণহানির ঘটনা এবং মাদক সেবনের প্রকোপ হয়ত কমানো যায়। রাবির প্রগতিশীল ছাত্রজোটের আহ্বায়ক মহব্বত হোসেন মিলন বলেন, মৃত শিক্ষার্থীদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তবে তাদের কখনও হতাশার কথা শুনিনি। তারা হয়ত শখেরবশে মদপান করতে পারে। কিন্তু তারা ভেজাল মদ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তারা অতিরিক্ত মদ খেয়ে মারা গেছে তা আসলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কেননা একই দিন এক রাশিয়ান নাগরিকও ভেজাল মদ খেয়ে মারা গেছেন। রাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মাহফুজুর রহমান এহসান বলেন, মাদকের বিস্তার বা সেবনের হার ক্যাম্পাসে যে হারে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। মাদক সেবনের বিরুদ্ধে সচেতন করার সঙ্গে সঙ্গে এই মাদক যেন শিক্ষার্থীদের কাছে সহজলভ্য না হয়, সেজন্য পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সকলকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। কিন্তু যদি কেউ ক্যাম্পাসের বাইরে মাদক সেবন করে সেটা আমাদের জানা খুব কষ্টকর। এজন্য সকলের সহযোগিতা দরকার। যাদের পরিচিতরা মাদক সেবন করছেন তারা যদি এসে আমাদের খবর দেন তাহলে তাদের ফিরিয়ে আনতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। এছাড়া ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রয় ও সেবনের বিরুদ্ধে প্রক্টরিয়াল বডি ও পুলিশ সবসময় সক্রিয় রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে, রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ কমিশনার ইফতেখায়ের আলম জানান, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময় সোচ্চার রয়েছে।
×