ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দীপা সিনহা

অভিমত ॥ সড়ক দুর্ঘটনা অতঃপর...

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৯ এপ্রিল ২০১৯

অভিমত ॥ সড়ক দুর্ঘটনা অতঃপর...

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এমন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে যে, প্রতিদিনের তালিকায় কিছু তাজা প্রাণ ঝরে যাবেই। গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩ হাজার মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। সমসংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে। মিডিয়ার এই যুগে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণগুলো আজ কারোই অজানা নয়। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে মানুষ স্বচক্ষে আজ সবই দেখতে পারছে। সেই দুর্ঘটনার কারণ ও তার সমাধানের করণীয় বিষয়গুলোও জানতে পারছে। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার বহুবিধ কারণসমূহ চিহ্নিত করে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে সোচ্চার। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর পরিবারকে হারিয়ে প্রথম থেকেই ‘নিরাপদ সড়কে’র দাবিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তবুও কিন্তু সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। শহরের যানজটের মধ্যেও যেমন মানুষ মারা যাচ্ছে, তেমনি ভোরের ফাঁকা রাস্তাতেও স্কুলগামী বাচ্চাদের জীবন দিতে হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই দেশের অধিকাংশ মানুষেরই দাবি শিক্ষিত চালকের হাতে গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দেয়া হোক। শিক্ষিত মানুষ সর্বকাজেই শ্রেয়। তবে কর্মক্ষেত্রে সকল মানুষই কি বিতর্কের উর্ধে? শিক্ষিত মানুষও অনেক সময় আইন ভঙ্গ করে পথ চলে। উল্টোপথে গাড়িও চালায়। এ দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা আজও যেন তাদের হাতে বাধা। যে দেশে তারেক মাসুদ (চলচ্চিত্র নির্মাতা) ও মিশুক মনিরদের (টিভি সাংবাদিক) মতো ‘খ্যাতিমান মানুষদের মামলার রায় পেতে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়, সেখানে সাধারণ মানুষদের বিচারের রায়ের যে কি অবস্থা তা তো সহজেই অনুমেয়। প্রথমত সড়ক ও সড়ক পরিবহন নির্মাণের ত্রুটির মধ্য দিয়েই সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়ে থাকে। অথচ সব দায় মাথায় নিয়ে প্রথমত গাড়ির চালককেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। কারণ সরাসরি চালকের হাতেই যে দুর্ঘটনাটি ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে গবেষক মান্নান চৌধুরী একটা কথা বলেছেন তা হলো আমাদের দেশের চালকদের যদি উন্নত দেশে গাড়ি চালাতে দেয়া হয় তখন কিন্তু তাদের দ্বারা কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না। এতেই বিষয়টা স্পষ্ট হয় যে, এই দুর্ঘটনার পেছনে কত মানুষের কাজের দায়িত্বহীনতা দায়ী। তবে শিক্ষিত চালকের দাবি সময়োপযোগী হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়। কারণ, এই পরিবহন খাতের ওপর অনেক মানুষেরই জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে যত মানুষই যতভাবেই জড়িত থাক না কেন, সবারই অভিযোগ কিন্তু ওই চালক আর সহকারীদের দিকে। তাদেরই অদক্ষতা, দুঃসাহস, আর অসচেতনতার কারণেই নাকি এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। অতএব, সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে বিষয়টাকে নিয়ে অন্যভাবে ভাবতে হবে। অর্থাৎ তাদের শিক্ষিত সচেতন মানুষদের মতো করেই আমাদের গড়ে নিতে হবে। সরকার তো দেশের নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য অনেক সময়ই অনেক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে থাকে। তাদের আবাসনের ব্যবস্থাও করে। অথচ পথ চলতে যাদের ওপর আমাদের জীবনকে শপে দিতে হয়, সেই সব স্বল্প শিক্ষিত, নিরক্ষর ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য আজ অবধি কোন কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের জীবনমানের উন্নয়নের কথা ভাবা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তাদের আমাদের গড়ে নিতে হবে। প্রথমত, যথাযথ নিয়মে দক্ষ চালকের হাতে গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দিতে হবে। এরপর তাদের একটা সুস্থ জীবনধারার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং তাদের জন্য একটা বাসযোগ্য সুস্থ পরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়ির কাজে যুক্ত এই সব স্বল্প শিক্ষিত বা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে তাদের সড়ক ও পরিবহনের সর্বপ্রকার নিয়ম-কানুনের পাশাপাশি গাড়ির যাত্রীদের সঙ্গে তাদের আচার আচরণ কিরূপ হওয়া উচিত, সে বিষয়েও যথোপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। সম্ভব হলে তাদেরকে প্রাথমিক পড়াশোনারও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেননা লিখতে পড়তে শিখলে তারা বিভিন্ন বইপত্র পড়ে জীবনটাকে একটু সমৃদ্ধ করতে পারবে। আর এই জায়গাটাতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা করতে পারে। কারণ তাদের তো প্রায়শই স্বেচ্ছায় পথে নেমে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করতে দেখা যায়। সড়ককে ‘রক্তমুক্ত’ করতে সকলের হাতকেই কাজে লাগাতে হবে। এক কথায়, সময়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি গাড়ির চালক-সহকারীদের আরও দক্ষ সভ্য স্মার্ট ও সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এক মাথা উস্ক-খুশকো, লালচে চুল, পরনে একখানা নরম লুঙ্গি, গালভরা পান, বাঁ-হাতে সিগারেট এবং ডান হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং এ দিনের অবসান ঘটাতেই হবে। গাড়ির চালক ও সহকারীদের প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট ড্রেস ও আইডি কার্ড থাকা উচিত। একটা ছোট গাড়ির চালক ও সহকারীদের জন্যও তা বাঞ্ছনীয়। এতে তাদের মাঝেও আত্মমর্যাদা বাড়বে। এতে তাদের কাজের দায়িত্বও বাড়বে। গাড়ির সকল যাত্রীকেও গাড়ির- চালক এবং সহকারীদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। একজন গাড়ির চালককে ‘এই ব্যাটা ড্রাইভার’ বলে না ডেকে ভদ্রোচিত ভাষায় ড্রাইভার সাহেব বলে ডাকলে ক্ষতি কি? উভয়ের প্রতিই উভয়কে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবহন মালিকদের সহযোগিতাও একান্ত কাম্য। এখানে সবাইকেই সততার সঙ্গে ও একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
×