ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাজারীবাগ মডেলে পুরান ঢাকা সাজানো হবে

প্রকাশিত: ১০:১৩, ৮ এপ্রিল ২০১৯

 হাজারীবাগ মডেলে পুরান ঢাকা সাজানো  হবে

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীর পুরান ঢাকার বর্তমান চেহারা পাল্টে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিক নগরী হিসেবে সাজাতে চায় সরকার। এলাকাবাসীর স্বার্থে গৃহীত নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে সরকারের নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে পুরান ঢাকার চেহারাই বদলে যাবে। শত সহস্র বছরের বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির ঘিঞ্জির পুরান ঢাকাবাসী প্রয়োজনীয় সকল প্রকার আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ ও বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়তে বর্তমান সরকার এক বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কয়েক ধাপে পুরান ঢাকা হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে শতভাগ বাসযোগ্য বড় বড় ভবন নির্মাণ করে দিতে চায় সরকার। ছোট ছোট এসব ভবনকে রিডেভেলপমেন্ট করে একসঙ্গে বড় ভবন তৈরি করে একই জমির মালিককে হিস্যা অনুযায়ী আলাদা আলদা ফ্ল্যাট তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকাকে বেছে নেয়া হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। রাজউক সূত্র জানায়, পৃথিবীর অনেক দেশ আরবান রিডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে তাদের শহরগুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে একইসঙ্গে ঘনবসতিপূর্ণ শহরেও এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া আরবান রিডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট গ্রহণ করে সফল হয়েছে। মূলত এরই অংশ হিসেবে সরকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের পর বর্তমানে এই এলাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে ভুলতে চায়। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রায় ৩১ বছর বিভিন্ন সরকারের লাগাতার চেষ্টা শেষে ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরিত করে বর্তমান সরকার। জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাজউকের সহযোগিতায় ভূমি মালিক সমিতির নিজস্ব উদ্যোগের মাধ্যমে, রাজউকের সহযোগিতায় ভূমি মালিক সমিতির সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানির চুক্তি করা, ভূমি মালিক সমিতির সঙ্গে রাজউকের চুক্তি করা, দেশী ও বিদেশী ঋণদাতা সংস্থার সহায়তা, বেসরকারী ব্যাংক অথবা সরকারী নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পের অর্থায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। প্রায় ৬৬ একরের এই জমিটিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে হাজারীবাগকে পুরান ঢাকার একটি মডেল এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে চায় রাজউক। এমনকি এই হাজারীবাগের পূর্বের ট্যানারি দ্বারা দূষিত হওয়া সকল মাটি সরিয়ে নিয়ে নতুন করে মাটি ভরাট করা হবে বলে জানা গেছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকার অন্য সকল এলাকায় বসবাসরত নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে পর্যায়ক্রমে সকল এলাকাকেই উন্নত শহরে রূপ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাজারীবাগে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজউক। একটি উন্নত আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়তে পার্ক, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট, ইনডোর গেমস, সুইমিংপুল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়সহ নানা ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সংস্থাটির করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে ৫শ ৮৭টি শিল্প-কারখানা, ৯৮টি বাণিজ্যিক ও ৯৪টি আবাসিকসহ মোট স্থাপনার সংখ্যা ৮শ ৭৪টি। হাজারীবাগ এলাকার মোট আয়তন ৬৫ দশমিক ৫৯ একর। এ সীমানার উত্তর পাশে রায়েরবাজার, পূর্বে জিগাতলা ও পিলখানা, পশ্চিমে হাজারীবাগ ও বেড়িবাঁধ, দক্ষিণে বোরহানপুর অবস্থিত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগর পরিকল্পনা, নগর উন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজউক অধিভুক্ত এলাকার পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে পরিকল্পনার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্যানারি মালিক এ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছে রাজউক। জানা গেছে, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে মালিকরা প্রাথমিকভাবে সম্মতি দিয়েছেন। এ নিয়ে সম্প্রতি পুনঃউন্নয়নের আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা হাজারীবাগ এলাকার সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজউককে তাদের মতামত জানিয়েছেন। এতে বলা হয়, বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের মাধ্যমে মাটি ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। কমপক্ষে ৮ ফুট লেয়ারের মাটি অপসারণ করতে হবে। জমির ওপর যথাসম্ভব স্থাপনা কম রেখে খোলা জায়গা বেশি রাখতে হবে, স্থাপনায় বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি এলাকাটিতে ভূমির মিশ্র ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং হাইজেনিক রাখতে হবে। কমিউনিটির অভ্যন্তরে গাড়ির চলাচল অনুৎসাহিত করা এবং অযান্ত্রিক বাহনকে উৎসাহিত করতে হবে। তবেই কেবল একটি ব্যবহার উপযোগী আধুনিক মডেল এলাকা হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভভ হবে। মডেল এলাকা গড়তে রাজউক বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ দূর করতে ভূমি মালিকানা পরিবর্তন পদ্ধতিতেও বসবাসরত নাগরিকদের স্বার্থেই করা হচ্ছে। জানা গেছে, প্রত্যেক ভূমি মালিক বর্তমান সম্পত্তির সমমূল্যের আবাসিক-বাণিজ্যিক স্পেস পাবেন। তবে সবার ব্যবহারের স্বার্থে সকল নাগরিকের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা কমিউনিটি স্পেসগুলো সমন্বিত মালিকানায় রাখা হবে। প্রকল্প এলাকায় বর্তমান বাজারমূল্যে বিদ্যমান জমির মূল্যায়ন হবে। মাল্টিপল লিনিয়ার রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের সমীকরণ হবে। বর্তমানে থাকা ঘর বা কাঠামোর প্রতিস্থাপন খরচ একই বিল্ডিং উপকরণের বর্তমান মূল্যে মূল্যায়ন করা হবে। বর্তমান কাঠামোর মূল্যনির্ধারণ (বিল্ডিং বয়স, উপকরণ খরচ এবং বাসস্থান ইউনিট) অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে, বর্তমান বাজারমূল্যে আশপাশের বিদ্যমান বাণিজ্যিক স্পেসের মূল্য নির্ধারণ হবে, মালিকানাধীন বেসরকারী জমির মালিক এবং যাদের মালিকানার কোন আইনী নথি নেই, কিন্তু জমিটি দীর্ঘ মেয়াদে ভোগ করছেন, তারা কর্তৃপক্ষের অধীনে গঠিত সম্পত্তি মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা নির্ধারিত সম্পত্তি পাবেন। এছাড়া প্রকল্প-পরবর্তী সম্পত্তি মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে উন্নত সুযোগ-সুবিধার কারণে জমির মূল্যবৃদ্ধি পাবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক জায়গা পাওয়া যাবে, যার বাজারমূল্য বর্তমানের অনুরূপ আবাসিক ও বাণিজ্যিক জায়গার চেয়ে বেশি হবে। বিষয়গুলো ভেবে প্রকল্পের আগেই প্রকল্প-পরবর্তী প্রাপ্ত সম্পত্তির মূল্য হিসাব করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাজারীবাগ এলাকার মাটি সরিয়ে ৮ থেকে ১০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত মাটি অপসারণ করে বিশুদ্ধ নতুন মাটি দিয়ে ভরাট করা হবে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ট্যানারি শিল্পের কারণে হাজারীবাগ এলাকার মাটি ক্রোমিয়াম, লেড ও আর্সেনিকের মতো ভারি ও বিষাক্ত ধাতু মিশে বিষাক্ত হয়ে আছে। অবস্থান ভেদে মাটির গভীরে এ দূষণের মাত্রা ৮ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত ছাড়িয়েছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানিও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। রাজউকের করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন ৭৫ টন কঠিন বর্জ্য এবং ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোন ধরনের পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি খোলা ড্রেন দিয়ে মাটি, পানি ও নদীতে গিয়ে পড়ত। এতে পুরো এলাকায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। বর্জ্যরে সঙ্গে মাটিতে গিয়ে মেশা ক্রোমিয়াম ধাতু মাটি ও পরিবেশের জন্য একটি ধীরগতির বিষ, যা কখনও ধ্বংস হয় না বরং ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাটির সঙ্গে মিশতে থাকে। ফলে হাজারীবাগের মাটি ও পানিতে ক্রোমিয়াম থেকে যাওয়ার ঝুঁঁকি রয়েছে। এ কারণে এখানকার ভূমি প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত দূষিত হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চাই পুরান ঢাকার বাসিন্দারাও নাগরিক হিসেবে সরকার প্রদত্ত সকল প্রকার সুবিধা নিয়ে জীবনযাপন করুক। অল্প জমিকে অধিক কাজে লাগিয়ে উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্যে বিশ্বের উন্নত দেশ সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপান, পার্শবর্তী দেশ ভারতও এই রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সফল হয়েছে। তাই আমরা হাজারীবাগকে রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে একটি বাসযোগ্য আধুনিক সুবিধার নগরী হিসেবে গড়তে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা পুরান ঢাকার ছোট ছোট সব ভেঙ্গে বড় ভবন তৈরি করে হিস্যা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দিতে চাই। ’১৭ সালের হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরের পর ওই এলাকাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে আমরা একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। রাজউককে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কোন পদ্ধতিতে পুরান ঢাকাকে নিরাপদ বাসযোগ্য করা যায় সেজন্য রাজউকের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান করা হয়েছে। এছাড়া নেয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মতামতও। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা, কর্মশালা, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কি কি নাগরিক সুবিধা পাবে উক্ত এলাকার নাগরিকরা তা জানতে স্থানীয়দের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করা হবে। এছাড়া কোন নাগরিক যেন কোন প্রকার ক্ষতির শিকার না হয়েও বর্তমানের চেয়ে আর উন্নত ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারেন তার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ বাসযোগ্য করে হাজারীবাগকে গড়ে তোলা গেলে পর্যায়ক্রমে পুরো পুরান ঢাকাকেই রিডেভেলপমেন্ট করা সম্ভব হবে। সরকারের নেয়া উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য তিনি পুরান ঢাকাসহ সংশ্লিষ্ট বাসিন্দা ও নাগরিকদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করেন।
×