ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখের প্রথম সকাল

পান্তাভাতে জল, তিন মরদের বল- সর্বজনীন পরিচিতি

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ৮ এপ্রিল ২০১৯

পান্তাভাতে জল, তিন  মরদের বল- সর্বজনীন পরিচিতি

সমুদ্র হক ॥ পান্তাভাত। বাঙালীর সর্বজনীন পরিচিতি তুলে ধরে। বৈশাখের প্রথম দিনের কাকডাকা ভোরে অন্যতম খাদ্য পান্তাভাত। পান্তা ছাড়া বৈশাখের উৎসব বৃথা। প্রবাদে আছে- পান্তাভাতে জল, তিন পুরুষের (মরদ) বল। কথাটি শরীরের শক্তি ধারণের প্রতীকী। একবিংশ শতকের খাদ্য বিজ্ঞানীগণ এই কথাটিই গবেষণায় প্রমাণ করেছেন। পুষ্টিমানে এগিয়ে আছে পান্তাভাত। পান্তায় উন্নতমানের শর্করা, আয়রন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম কায়িক শ্রমে দ্রুত শক্তি জোগায়। রক্তস্বল্পতার মানুষের পুষ্টিকর খাবার পান্তা। দূর অতীতের চিত্র- গাঁয়ের কিষান বধূ রাতের ভাত মাটির পাতিলে বেশি করে রান্নার পর খাওয়া সেরে বাকিটা ওই পাতিলেই পানিতে ভিজিয়ে রাখে। সকালে কৃষক ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকালীন কাজ সেরে পান্তাভাত ছেনে লবণ মরিচ পিঁয়াজ দিয়ে খাওয়ার পর জমিতে যায়। মাটির থালা (সানকি) ভরে পান্তাভাত খাওয়ার পর প্রখর রোদে ঘাম ঝরিয়েও কয়েকগুণ বেশি কায়িক শ্রমে তারা দিনের অনেকটা সময় কাজ করে। কোন ক্লান্তি আসে না। কোন কৃষক পান্তায় লবণ পিঁয়াজ মরিচের সঙ্গে আলু ভর্তা এবং গ্রীষ্মকালে কাঁঠাল খায়। এই ধারা কিছুটা কমতে শুরু করে নিকট অতীতে। বর্তমানে গ্রামের অনেক কৃষক পূর্বসূরিদের দেখানো পথে আজও পান্তাভাতের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। হালে প্রতিবছর বৈশাখের উৎসবে পান্তাভাতের মর্যাদা আরও অনেক বেড়েছে। জাতীয় মাছ ইলিশ পান্তাভাতের সঙ্গী হয়েছে। প্রকারান্তরে পান্তাভাতে উন্নতমানের খাদ্যমানের সঙ্গে ইলিশের খাদ্যমান যোগ হয়ে পান্তাভাতের খাদ্য রসায়নের গুণাগুণ আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ যুক্ত হওয়ার এই উদ্ভাবনটি কার তা নির্ণয় করা যায়নি। পান্তাভাতের পুষ্টিগুণ নিয়ে গবেষণা করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। একই সঙ্গে ভারতের অসম রাজ্যের কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের অনুজীব বিদ্যা বিভাগেও পান্তাভাত নিয়ে গবেষণা হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অসম মেঘালয় মনিপুরসহ কয়েক রাজ্যে পান্তাভাতের কদর বংশপরম্পরায় চলে আসছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিট পান্তাভাতের রাসায়নিক গুণাগুণ পরীক্ষা করে। এতে দেখা যায়, প্রতি এক শ’ গ্রাম পান্তাভাতে প্রায় ৬৯ মিলিগ্রাম আয়রন আছে। সাদাভাতে আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম। পান্তায় পটাশিয়াম আছে ৮শ’ মিলিগ্রাম। সাদাভাতে আছে মাত্র ৭৭ মিলিগ্রাম। পান্তায় ক্যালসিয়াম আছে ৭শ’ ৮৫ মিলিগ্রাম। সাদাভাতে আছে ২০ দশমিক ৩৫ মিলিগ্রাম। এর সঙ্গে পান্তায় সরাসরি লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) খাওয়ায় শরীরের লবণ ঘাটতি পূরণ হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইলেক্ট্রলাইট পরীক্ষায় মানবদেহের পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের মাত্রা দেখা হয়। মানবদেহে এই তিনটি রসায়নের সঠিক মাত্রা থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। একই গবেষণা ও বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভাতকে বিশুদ্ধ পানিতে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ফাইটিক এসিড, হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ায় ল্যাকটিক এসিড তৈরি হয়। ফলে ভাতের অণুপুষ্টি মুক্ত করে পান্তাভাতের রাসায়নিক গুণাগুণ অনেক বেড়ে যায়। পান্তাভাত ঠান্ডা খাবার। গরম আবহাওয়ায় পান্তার উচ্চমানের শক্তি শরীর ঠান্ডা রেখে তাৎক্ষণিক শক্তি আনে। পেটের সুস্থতায় ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য রক্ষায়, রক্ত স্বল্পতায়, অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ও নারী এবং গর্ভবতী নারীদের উপযুক্ত খাবার এই পান্তা। ভারতের অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিদ্যা বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপকের গবেষণায় একই রকম ফলাফল এসেছে। তাদের বিশ্লেষণ পান্তায় অম্লত্ব বেড়ে ক্ষারত্ব কমে যায়। পান্তায় এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ইস্ট শর্করা ভেঙ্গে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্টির ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রকাশনায় গবেষক অধ্যাপক মধুমিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, ভাত ১২ ঘণ্টা বিশুদ্ধ জলে ভিজিয়ে রাখলে আয়রন পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রথাগত এই খাবারটি খনিজ উপাদানের ভাল উৎস। প্রবীণ ব্যক্তিগণ বলেন, নিকট অতীতে গ্রামের প্রতিটি ঘরে গ্রীষ্মকালীন খাবারে পান্তাভাত অন্যতম। নগর জীবনেও পান্তাভাতের চল ছিল। খাদ্য বিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম বললেন, মাটির পাতিলে ও কাঠ খড়ির চুলায় প্রতিটি রান্না স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির পাতিলের রান্নায় মাটি তাপ শোষণের পর যে তাপ উৎপন্ন হয় তা নিয়ন্ত্রিত। খড়ির চুলার তাপ মৃদু। যা ধীরে ধীরে তাপ উৎপন্ন করে। দূর অতীতের কিষান বধূরা তাপ বাড়াবার প্রয়োজনে খড়ির তাপে তুষ (ধানের গুঁড়া) ছিটিয়ে দিত। এই তাপ নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি সহায়ক। কাঁচা মরিচ বা শুকনো লাল মরিচ লবণ ও পিঁয়াজ পান্তাভাতের সঙ্গে মিশে দেহকে শক্তিশালী করার উপাদান তৈরি করে। পান্তাভাত পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে বাঙালীর জীবনের সংস্কৃতি চিরন্তন করে রাখছে। পান্তাভাত ও বাঙালী সমান্তরাল পরিচিতি তুলে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
×