ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসাব্যবস্থা ॥ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়ন জরুরী

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৮ এপ্রিল ২০১৯

 চিকিৎসাব্যবস্থা ॥ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়ন জরুরী

দেশের হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণ ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী নির্দেশনা জনগণের মাঝে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে। হাসপাতালগুলো পরিবেশবান্ধব করা অর্থাৎ খোলামেলা রাখা এবং রোগীদের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাবার মতো করে অবকাঠামো নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রমাণ করে দেশের মানুষের প্রতি তার সীমাহীন দরদের কথা। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাতেও বোঝা যায়, মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। এছাড়া হাসপাতালে ডে-কেয়ার সেন্টার রাখা, রোগের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা ব্লক তৈরিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যথেষ্ট উদ্দীপনামূলক। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ধরনের নির্দেশনা ‘জনবান্ধব চিকিৎসাব্যবস্থা’ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত বলে বিবেচনা করা যায়। এর মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় থাকা আস্থার সঙ্কট যে ব্যাপকহারে কমে আসবে সেটা নিশ্চিত। গত ১২ মার্চ মঙ্গলবার একনেক সভায় ‘সরকারী কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সরকারী হাসপাতালেই যাতে চিকিৎসকরা একটা উইং (শাখা) নিয়ে বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারেন সেভাবেই হাসপাতালের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। চিকিৎসক ও রোগীরা বাইরে বাইরে দৌড়ায়। এখানেই (হাসপাতালে) তাদের একটা সুন্দর জায়গা দিয়ে দেন। এখানেই তারা (চিকিৎসক) প্র্যাকটিস করুক। যাতে বাইরে যেতে না হয় এবং রোগীরাও সরকারী হাসপাতালেই সেবা পান।’ প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে রোগী এবং চিকিৎসকদের সম্পর্কও অনেকটা বন্ধুভাবাপন্ন হবে। দেশের চিকিৎসা খাত নিয়ে জনগণের মধ্যে কমবেশি আস্থার সঙ্কট এবং ক্ষোভ রয়েছে। আর চিকিৎসাব্যবস্থা বা সংশ্লিষ্টদের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা করতে যান। এটি কখনোই বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারের জায়গাটিতে যখন ভালবাসার চেয়ে ব্যবসা গুরুত্ব পায় তখন মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে। আর অসহায় মানুষের আস্থাহীনতা ক্ষোভের স্তর ভারি করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে তার সবই কেটে যাবে বলে আশা করা যায়। শুধু সরকারী কর্মচারী হাসপাতালই নয়, দেশের সব হাসপাতালে এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত। বাংলাদেশে ভাল চিকিৎসক, সেবক এবং উন্নত যন্ত্রপাতি প্রচুর রয়েছে। কিন্তু রোগীর প্রতি একশ্রেণীর চিকিৎসকের মনোযোগের অভাব ও ব্যবসায়িক মানসিকতা, সেবকদের একটি অংশের যথাযথ সহযোগিতার মনোভাবে ঘাটতি, রোগ নির্ণয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরীক্ষার দর সবস্থানে একরকম না হওয়ায় মানুষের মাঝে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সরকারী হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এসেছে ঠিকই, কিন্তু একশ্রেণীর চিকিৎসক বা সেবক-সেবিকার অমনোযোগিতার বিষয়টি আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনও সরকারী হাসপাতালের বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক পূর্ণ সময়জুড়ে তার কাজটি করেন না। সেবক-সেবিকাদের আন্তরিকতার ঘাটতি এখনও বহাল রয়েছে। অথচ মানুষের জীবন রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করার অঙ্গীকার নিয়ে এ পেশায় আসতে হয় তাদের। এই পরিস্থিতিতে জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে গুণগত পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছেন তার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। চিকিৎসা খাতকে নিয়মের মধ্যে আনতে অনেক আইন, বিধি বা নিয়ম-কানুন রয়েছে। সেগুলোর খুব বেশি ফল যে পাওয়া গেছে তা নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখা যেতে পারে- ১. দেশের সব সরকারী হাসপাতালে আলাদা একতলা বা বহুতল ভবন করে ডক্টরস চেম্বার তৈরি করা। যাতে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার কর্মস্থলেই একটি নির্দিষ্ট সময় রোগী দেখতে পারেন। ২. চিকিৎসকদের রোগী দেখার একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে। যেটি দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক হতে পারে। প্রয়োজনে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কিছু কমবেশি হতে পারে, তবে সেটা যাতে মাত্রাতিরিক্ত না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। ৩. চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেয়া। এটি হতে পারে চিকিৎসকের সিনিয়রিটি অনুযায়ী বা তার সর্বশেষ প্রাপ্ত বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে। অথবা ক্যাটাগরি (মেডিসিন, নিউরো মেডিসিন, নিউরো সার্জারি, গাইনি এ্যান্ড অবস, গ্যাস্ট্রোলজি ইত্যাদি) অনুযায়ী। এই ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান, মূল্যস্ফীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আমলে রাখতে হবে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি বাড়ানো যেতে পারে। ৪. বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রতি সপ্তাহে তার সুবিধামতো সময়ে গ্রামাঞ্চলে রোগী দেখার বিশেষ ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। ৫. ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর গ্রেডিং বা মান নির্ধারণ করে দেয়া। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একই ধরনের পরীক্ষার দর সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই হারে হচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করা। ৬. বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর গ্রেডিং বা মান নির্ধারণ করে দেয়া। সমপর্যায় বা সমমানের সব বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে বেড, রুম, আইসিইউ, সিসিইউর দর একইরকম হওয়া প্রয়োজন। ৭. প্রতিটি বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সব ধরনের ফ্রি বেড বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সেটি যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি-না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা। ৮. সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে রোগীর জন্য একটি নির্দিষ্ট ফরম তৈরি করে দেয়া। যাতে রোগী বা তার এ্যাটেনডেন্ট স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবেন। এতে করে চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের সময় বাঁচবে। ৯. চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা, হাসপাতাল-ক্লিনিক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পুরস্কার বা পদক চালু করা। যার নাম হতে পারে ‘বঙ্গবন্ধু চিকিৎসাসেবা পদক’। প্রতি বছর সেরা চিকিৎসক, সেরা সেবক-সেবিকা, সেরা সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ পদক পেতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের একাংশ বরাবরই সচেষ্ট। কিন্তু সঙ্কট কাটছে না। এত চেষ্টার পরও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থার সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। কোন রোগী যখন চিকিৎসকের মুখোমুখি হন, তখন তিনি চান চিকিৎসক তার বিস্তারিত বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সেবক বা সেবিকা তার যত্নটি যথাযথভাবে নিক। কিন্তু সব চিকিৎসক বা সেবকের কাছে সেটি পান না রোগীরা। ফলে হতাশা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে নয় দেশে চিকিৎসা নেয়ার কথা বলেন। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আস্থার সঙ্কট কাটাতে বা আরও প্রগাঢ় আস্থা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবন দান করেন, আর চিকিৎসকরা জীবন রক্ষা করেন। সে কারণে চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। এটিকে সেবা বলেও বিবেচনা করা হয়। সেই সেবা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের মানুষ চিরপুজনীয় করে রাখতে চায়। সেজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ত্যাগ করা এবং আচরণে গুণগত পরিবর্তন আনা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), চিকিৎসক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে যুথবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দলীয় বৃত্তের উর্ধে উঠে দেশ ও মানুষের কল্যাণে সকলকে এগিয়ে এসে চিকিৎসা ব্যবস্থায় থাকা গলদ ও সঙ্কট দূর করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাকে বাস্তবে রূপ দিতে দেশের চিকিৎসক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশে প্রকৃতঅর্থে ‘গণমুখী চিকিৎসাব্যবস্থা’ গড়ে তোলা দুরূহ নয়। সেজন্য জনগণ প্রস্তুত রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও চিকিৎসক সমাজের ঐকান্তিক আগ্রহ। লেখক : সাংবাদিক
×