রাজন ভট্টাচার্য ॥ জাতীয় পার্টির গত দুই সপ্তাহের গৃহবিবাদের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যায়ে। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২২ মার্চ গভীর রাতে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরই জাপায় নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি হয়। দল চালাতে ব্যর্থ, সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় না করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে কো-চেয়ারম্যান পদ ও পরের দিন বিরোধীদলের উপনেতা থেকে বাদ দেয়া হয় সহোদর কাদেরকে। এতে পার্টির কয়েক সিনিয়র নেতা খুশি হলেও বেঁকে বসেন বৃহত্তর রংপুরের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীর একটা বড় অংশ । দুই সপ্তাহ না পেরুতেই সর্বস্তরের নেতার চাপের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বৃহস্পতিবার রাতে পুনরায় কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় জিএম কাদেরকে।
শনিবার সকালে অপর এক সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদ তার অবর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যান হবেন জিএম কাদের এমন এক নির্দেশনা গণমাধ্যমে পাঠান। এরশাদের এ সর্বশেষ নির্দেশনা যাতে আর কেউ পরিবর্তন করতে না পারে সেজন্য শতাধিক নেতাকর্মী দিনভর এরশাদের বারিধারার বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে জাপার সিনিয়র নেতারাও এরশাদের বাসভবন এড়িয়ে চলছেন। এ নিয়ে জাপার দু’পক্ষের নেতাকর্মীর মধ্যে কিছুটা চাপা উত্তেজনাও বিরাজ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শনিবার বিকেলে এরশাদের বাসার সামনে পুলিশী নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।
নেতাকর্মীরা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে বার বার মত পাল্টানো একমাত্র রাজনীতিবিদ হলেন সাবেক স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদ। নিজেরে স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হন না। যখনতখন স্ত্রী, ভাইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর হতে দেখা যায় তাকে। আবার চাপের মুখে অল্প সময়ের মধ্যে নতি স্বীকার করারও নজীর অহরহ। তাই এরশাদকে কেউ বিশ^াস করতে রাজি নন। যে কোন সময় রওশন এরশাদসহ তার রাজনৈতিক সতীর্থরা বাসায় এসে এরশাদকে দিয়ে জিএম কাদেরকে নিয়ে সকল নির্দেশনা ফের পাল্টে দিতে পারেন। তাই সহসাই নেতাকর্মীরা সরতে রাজি নন।
এদিকে, এরশাদের দ্রুত সিদ্ধান্তের পরিবর্তনের বিষয়ে জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্য বলেন, রংপুরের কয়েক নেতাকর্মী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অনেকটা জিম্মি করে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল করতে বাধ্য করেন। রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, বৃহত্তর রংপুরের মাটি ও মানুষ এরশাদের প্রাণের স্পন্দন। আমরা চাই জাতীয় পার্টি বেঁচে থাকুক। কিন্তু দলের ভেতর একটি কুচক্রী মহল জিএম কাদেরসহ পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তাছাড়া আমরা এরশাদকে জিম্মি করিনি। ষড়যন্ত্রকারীরাই এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে পার্টিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছেন। এরশাদই আমাদের তার বাসভবনে ডেকেছিলেন।
জাপা সূত্র থেকে জানা যায়, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা না বলে জিএম কাদেরকে পুনর্বহালে ক্ষুব্ধ তার বিরোধীরা। জাপার অপর এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়েছে। সংসদে ২২টি আসন পেয়েছে সরকারের সমর্থনেই। কিন্তু জিএম কাদের এ বাস্তবতা মানতে চান না। তাছাড়া জিএম কাদেরকে এখন আমলাভাব ছাড়তে হবে। তিনি পার্টি চালাতে কারও সহযোগিতাও চান না। এভাবে দল চলতে পারে না। জাপা ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এ বিষয়ে বলেন, জাতীয় পার্টি সব সময় এরশাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলে। আমরা তার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তবে, সাম্প্রতিক জাপার নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন মহলে জাপার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও পার্টির অধিকাংশ নেতাকর্মী চেয়ারম্যানের যেকোন সিদ্ধান্তের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল। এতে সমালোচনার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।
এদিকে জাপায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের মাঝে হঠাৎই এরশাদের বাসভবন ও বনানী কার্যালয়ে পার্টির তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মীর উপস্থিতি বেড়ে গেছে। তারা জড়ো হয়ে উত্তপ্ত স্লোগান দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে কোন নেতা এরশাদের বাসভবনে এলে তাদের প্রতিহত করা হবে বলেও হুমকি দেন তারা। এ বিষয়ে পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় বলেন, দুই সপ্তাহ যাবত পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কুচক্রী মহল দলকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছেন। ভেবে দেখতে হবে এদের উৎপত্তি কোথায়। যারা ষড়যন্ত্র করছেন তারা এক সময় বিএনপি থেকে এ পার্টিতে এসেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এরশাদের বুকে ছুরিকাঘাত করে চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন। সরকারের কাছে অনুরোধ, সরকারী সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যেন জাপা ভাঙ্গার মিশনে কেউ লিপ্ত না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারণ অনেকে জাপাকে ভেঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের মিশন বাস্তবায়ন করতে চায়।
জাপার সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল্লাহ শফি বলেন, জাতীয় পার্টি সবসময় আগুন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। জিএম কাদের সবসময় সরকারকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করে আসছে। তাই দলে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছিল।
এর আগে, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল করতে বৃহত্তর রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা দলের চেয়ারম্যানকে ৫ তারিখ পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেন। এই তারিখের মধ্যে জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল না করলে তারা গণপদত্যাগের হুমকি দেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ বিদেশেও অবস্থনারত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিএম কাদেরকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
ঢাকায় রওশনের অনুসারী ও দলের প্রভাবশালী কয়েক প্রেসিডিয়াম সদস্য যেন কোনভাবে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল করা না হয় সেজন্য এরশাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে। এর মধ্যে গত ৩ এপ্রিল রংপুরের সিটি মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে বৃহত্তর রংপুর বিভাগের র্শীষ নেতারা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে এরশাদের সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠক করেন। বৈঠকের পরদিনই আবারও এরশাদ বিশেষ সিন্ডিকেটের চাপ উপেক্ষা করে বৃহত্তর রংপুরসহ সারাদেশের তৃণমূল জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীর দাবির মুখে আল্টিমেটামের মুখে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহাল করেন। শনিবার এরশাদের অবর্তমানে ভাইকে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীরা আশা করেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই বিরোধী দলের উপনেতার পদও ফিরে পাবেন কাদের।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: