ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিপুল বিনিয়োগের অভাবে বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হচ্ছে না

প্রকাশিত: ১০:০৭, ৭ এপ্রিল ২০১৯

 বিপুল বিনিয়োগের অভাবে বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হচ্ছে না

রশিদ মামুন ॥ বিপুল বিনিয়োগ করতে না পারায় বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন পিছিয়ে পড়ছে। অভিযোগ উঠেছে সরকার উৎপাদন এবং সঞ্চালনে যতটা নজর দিচ্ছে ঠিক ততটা নজর নেই বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে। ফলে গ্রাহকের কাছে মানসম্মত এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করাও সম্ভব হচ্ছে না। হিসেব বলছে বিদ্যুত ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্তত ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে এত বিপুল বিনিয়োগ সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সারাদেশে ৩ কোটি ৩০ লাখের মতো বিদ্যুত গ্রাহক রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবার ঘরেই বিদ্যুত দিতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যুত বিভাগ দাবি করছে সারাদেশের অন্তত ৯৩ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছেছে। বাকি ৭ ভাগ মানুষের ঘরে এ বছরের মধ্যে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদা আগে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত, যা বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে এখনই দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এখন বিদ্যুত বিতরণ মূলত বিভিন্ন কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারী হলেও বিতরণ কোম্পানিগুলো কোম্পানি আইনে পরিচালিত। সরকার চাইছে বিতরণ কোম্পানিগুলো রাজস্ব আদায় করে নিজেদের মতো করে চলুক। সরকার উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি দিলেও বিতরণ পর্যায়ে তা দেয় না। নতুন নতুন প্রকল্প করার জন্য এসব কোম্পানি সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকে। যদিও আধুনিক ও মানসম্মত সেবা দেয়ার জন্য সেই অর্থে বিশদ প্রকল্প নেয়া কঠিন। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান বা বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় দেখা গেছে, বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে ’৪১ সাল পর্যন্ত প্রয়োজন ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ’১৭ থেকে ’২৫ এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার, ’২৬ থেকে ’৩০ পর্যন্ত সাত বিলিয়ন ডলার, ’৩১ থেকে ’৩৫ এর মধ্যে আর ৭ বিলিয়ন ডলার, বাকি ৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন ’৩৬ থেকে ’৪১ সাল পর্যন্ত। সরকার ’১২ সালের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে সেই সময়সীমা আরও তিন বছর বাড়িয়ে ’১৫ করা হয়। কিন্তু এখন এসে বলা হচ্ছে আরও সময় প্রয়োজন। কিন্তু কত দিন তা এখনও স্পষ্ট করা হচ্ছে না। বিদ্যুত জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সরকারকে এজন্য সময় দিতে হবে। তিনি বলেন, এখন মানুষের কাছে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুত পৌঁছে দেয়াই আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছি। দেশের গ্রিডভুক্ত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের উপরে, কিন্তু গ্রীষ্মে চাহিদা সর্বোচ্চ ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু এই পরিমাণ বিদ্যুত বিতরণ করতে গিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে উঠে বিদ্যুত খাত। গ্রীষ্মে বিদ্যুত বিতরণ করতে গেলেই এখনও ওভারলোডের সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে বিতরণ গ্রিডকে। দেশে এখন পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির পাশাপাশি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুত বিতরণ করছে। কোন কোম্পানিই এখন পর্যন্ত স্মার্টগ্রিডের কোন প্রকল্প হাতে নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক এই বিতরণ ব্যবস্থায় বিদ্যুত সরবরাহের তাগিদ রয়েছে। তবে পুরান বিতরণ ব্যবস্থার বদলে নতুন করে সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের দরকার, যা বিতরণ কোম্পানির একার পক্ষে বহন করা কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিতরণ ব্যবস্থার সব শেষ প্রযুক্তি হচ্ছে স্মার্টগ্রিড। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন গ্রাহক নিজে যেমন তার বিদ্যুত ব্যবহার তদারকি করতে পারেন একইভাবে বিতরণ ব্যবস্থাও আধুনিক ও ত্রুটিহীন করা সম্ভব। বিতরণ ত্রুটি খুঁজে পেতে সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই পদ্ধতিতে এক জায়গায় বসেই ত্রুটি চিহ্নিত করার পাশাপাশি সারানোও সম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন দুর্ঘটনায় যদি একটি বাড়ি বা এলাকার বিদ্যুত ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায় তবে সেন্সর ও স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে স্মার্টগ্রিড খুব সহজেই এই সমস্যা বুঝতে পারবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এক জায়গায় দুর্ঘটনার কারণে অন্য এলাকার বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার যেন ক্ষতি না হয় স্মার্টগ্রিড সে বিষয়ে সাহায্য করবে। জানা গেছে স্মার্টগ্রিড প্রথায় গ্রাহক ‘মোবাইল প্ল্যানের’ মতোই নিজের ‘বিদ্যুত প্ল্যান’ বেছে নিতে পারবেন। তৈরি হবে একটি আধুনিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। বাড়ি বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মিটার বক্সে ‘সিম কার্ডের’ মতো কার্ড থাকবে, যে কার্ডের মাধ্যমে ১৫ মিনিট অন্তর কত বিদ্যুত খরচ হয়েছে তার তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে যাবে। চাহিদা কমে গেলে বা বৃদ্ধি পেলে আপনা আপনি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই পদ্ধতি শিল্প ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্মার্টগ্রিড প্রবর্তনের শুরুতে শিল্প এলাকা দিয়ে শুরু করেছিল। তবে সারাদেশে স্মার্টগ্রিডের প্রবর্তন করা সম্ভব হলে পিক (সর্বোচ্চ চাহিদার সময়) এবং অফপিক (সর্বনিম্ন চাহিদার সময়) বিদ্যুতের দামও পৃথকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। এতে মূল্য বিবেচনা করে গ্রাহক বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু স্মার্টগ্রিডসহ বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে যে পরিমাণ ব্যয় করা দরকার তা এখনই সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুত বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, উন্নত দেশে বিদ্যুতের দুটি লাইন থাকে। কোন কারণে একটির বিদ্যুত চলে গেলে অপরটি আপনা থেকেই চালু হয়। আমাদের এখানেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সেই ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সব গ্রাহক সেই সুবিধার আওতায় নেই। ফলে ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে। সকল গ্রাহকের জন্য সেই সুবিধা দিতে পারলেই কেবল গ্রাহক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাবে। কিন্তু যথেষ্ট বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা আমাদের থাকলেও এখনও লোডম্যানেজমেন্ট করে আমাদের চলতে হচ্ছে। এতে গ্রাহক ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে।
×