ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লোকায়ত জীবনে ফেরার চির আকাঙ্ক্ষা, বর্ণাঢ্য উৎসব প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ১০:০৫, ৭ এপ্রিল ২০১৯

লোকায়ত জীবনে ফেরার  চির আকাঙ্ক্ষা, বর্ণাঢ্য  উৎসব প্রস্তুতি

মোরসালিন মিজান ॥ সব ভুলে যাই, সব ভুলে যাই/তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল।/টাকডুম টাকডুম বাজাই/আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল...। বাংলাদেশের ঢোলটি খুব বাজছে এখন। সারা বছর, হ্যাঁ, একটু ভুলে থাকা। অন্যের আচার। কিন্তু শেকড়ে ফিরতে হয়। শেকড়ে ফেরানোর বৈশাখ আসছে। এরই মাঝে বাউলমনের একতারাটা সুর তুলছে বুকের ভেতর। মাটির সরা হয়ে উঠেছে রঙিন ক্যানভাস। চৈত্রের বাতাসও যেন এমনি এমনি বইছে না। বৈশাখের আগমনী ঘোষণা করছে। লোকজীবনে ফেরার চির আকাক্সক্ষাকে নতুন করে জাগিয়ে দিচ্ছে। এভাবে মূল উৎসবের আগেই উৎসবের আমেজ। সব ধর্মবর্ণের মানুষ এক সঙ্গে এই উৎসব উদ্যাপন করবে। মহাধুমধামের সঙ্গে বরণ করে নেবে নতুন বছর ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে। সারা দেশের মতো ঢাকায়ও জোরেশোরে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। রাজধানী শহরের যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বৈশাখ। নতুন বছরের আগমনী বার্তা। এ আলোচনার প্রথমেই আসে ছায়ানটের কথা। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। ‘কায়মনে বাঙালী’ হবার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু। পাঁচ দশক ধরে চলছে। এবারও বছরের প্রথম দিন ভোরবেলায় মানুষের স্রোত নামবে রমনায়। আপাতত চলছে প্রস্তুতি পর্ব। অনুষ্ঠান সফল করতে প্রতিষ্ঠানের খুদে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ছায়ানট ভবনে সমবেত হচ্ছে। শিক্ষকরা আসছেন। সবাই মিলে সুর ঠিক করছেন। বাণী শুদ্ধ করছেন। রমনায় মঞ্চ তৈরির কাজও শুরু হয়ে গেছে। বিশাল মঞ্চে শতাধিক শিল্পী সম্মেলক ও একক গান করেন। থাকবে কবিতা ও পাঠ। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের ভাষায়- পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বাঙালিত্বের সাধনা। নিয়ত এই সাধনা করে যেতে হয়। আমরা তা-ই করছি। বাংলা নববর্ষ বরণের এই অনুষ্ঠান সবার জন্য উন্মুক্ত। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। তাদের মাঝেও এক ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্ষবরণ উৎসবের অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজনটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। বহু বছর ধরে শোভাযাত্রাটি আয়োজন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ সকালে অনুষদের সামনে থেকে বিশেষ এই র‌্যালি বের করা হয়। এবারও চলছে জোর প্রস্তুতি। আয়োজকরা জানান, ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব ধর্মবর্ণের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করবেন। র‌্যালি থেকে লোকায়ত জীবন ও শেকড়ের সংস্কৃতিকে উর্ধে তুলে ধরা হবে। সে লক্ষ্যে চলছে প্রস্তুতি। গত কয়েকদিন চারুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বড় বড় স্ট্রাকচারাল ফর্ম গড়ে তোলা হচ্ছে। ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে পাখি, ঘোড়া ইত্যাদির অবয়ব। পুতুলের ফর্ম কাজে লাগিয়ে নতুন শিল্পকর্ম গড়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। এগুলোই শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ হবে। আগেভাগে শিল্পকর্মগুলো দেখার জন্য প্রতিদিনই ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। তাদের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে পুরো প্রাঙ্গণ। জয়নুল গ্যালারির সামনে চলছে সরাচিত্র আঁকার কাজ। কাগজের পাখি বানানো হচ্ছে। এসব দেখে যারপরনাই মুগ্ধ তারা। অনেকেই এখান থেকে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করছেন। তাদের একজন আরিফ হোসেন। একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার এই কর্মকর্তা বলছিলেন, পহেলা বৈশাখে আমাদের অফিসে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। একই কারণে সাজানো হবে প্রতিটি কক্ষ। শিক্ষার্থীদের তৈরি এসব নান্দনিক সামগ্রী এ ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে আসে বলে জানান তিনি। বলেন, এ জন্য চারুকলা থেকে সরাচিত্র মুখোশ ইত্যাদি কিনতে এসেছি। অনুষদের শিক্ষার্থী মৃণাল জানান, চৈত্রের শেষদিন পর্যন্ত শিল্পকর্ম গড়া ও বিক্রির কাজ চলবে। এ প্রসঙ্গে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, আমাদের প্রস্তুতি যথানিয়মে এগিয়ে চলেছে। সময়মতো শেষ হবে। এবারও আয়োজনটি বর্ণাঢ্য করার চেষ্টা হচ্ছে জানিয়ে সবাইকে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি। মূল দুটি আয়োজনের বাইরেও নানা প্রস্তুতি চলছে। হাইকোর্ট সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে বসেছে মৃৎশিল্পের পসরা। সব সময়ই দেখা যায়। তবে এখন অনেক বেশি। মাটির ছোট ছোট সরাকে উজ্জ্বল রঙে এঁকে নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রকমের পাত্রের গায়ে প্রাকৃতিক রং। ফোক মোটিফ। শখের হাঁড়ির কথা তো না বললেই নয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের হাঁড়ি পাটের শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। চেনা দোকানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে বাঁশের তৈরি কুলা। আলপনা আঁকা কুলা বিছিয়ে রাখা হয়েছে পথের ধারে। আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ঝুড়ি। দোকানিদের কর্মব্যস্ততাও চোখ এড়ায় না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল কাঁচের চুরির পসরা। একসময় চুরি বলতে এই কাঁচের চুরিকেই তো বোঝাত। মেয়েরা হাতভর্তি করে এসব চুরি পরত। এখনও আছে। মেঝেতে পলিথিন বিছিয়ে সেখানে চুরি সাজিয়ে রেখেছিলেন দোকানিরা। তাই দেখে তরুণীরা এসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। বিশেষ কায়দায় আস্তে আস্তে চুরি পরিয়ে দেয়ার কাজ করছিলেন বিক্রেতা নারীরা। বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী হাসনু হেনা চুরি কিনলেন বটে। হাতে পরলেন না। কেন? জানতে চাইলে তিনি বললেন, পহেলা বৈশাখে পরব। আগে কিনে রাখলাম। শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কাঁচের চুরি পরবেন বলে জানান তিনি। বাঙালীর নববর্ষ উদ্যাপনে চাই মুড়ি-মুড়কি-বাতাসাও। গ্রামের মেলা ঘুরে এসব খাবার খাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দায়। শহরেও আছে। এতদিন কখনওসখন চোখে পড়েছে। বৈশাখ সামনে রেখে দেখা যাচ্ছে নিয়মিতই। ভ্যানে বিক্রি করা হচ্ছে খৈ, মুড়ি, চিনির বাতাসা। চিনির ঘোড়া, হাতিও পাওয়া যাচ্ছে। কামড়ে দিব্যি খেয়ে ফেলা যায়। মিষ্টিও খুব। টিএসসির বিপরীত দিকে সুযোগ পেলেই দোকানগুলো বসছে। চাহিদাও আগের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। আর নতুন পোশাক তো না হলেই নয়। এই কেনাকাটা আগেই শুরু হয়েছিল। এখন জমজমাট। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো যোগান দিচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। অন্যান্য দোকানেও এখন দেশীয় পোশাকের প্রাধান্য। চলছে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও ফ্যাশন শো। এভাবে সর্বত্রই উৎসবের আমেজ। শহরে দৃশ্যমান হচ্ছে গ্রাম। বাঙালিত্বের জয়জয়কার হচ্ছে।
×