ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেল শহর ‘পার্বতীপুর হানাদারমুক্ত’

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ৭ এপ্রিল ২০১৯

রেল শহর ‘পার্বতীপুর হানাদারমুক্ত’

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল দিনটি ছিল বুধবার। বাঙালীর সুমহান মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। হাইকমান্ড নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করা। কলকাতায় এম মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামানকে খুঁজে পেলেন। তাঁরাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক, যাঁরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সরকার গঠনের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের শাণিত যুক্তি সবাই মেনে নেন। মুক্তি সংগ্রামের এই দিনে নয়াদিল্লীর পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা শাহাব উদ্দিন আহমদ ও আমজাদুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁরাই বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী প্রথম কূটনৈতিক। মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার ও মওলানা নূরুজ্জামান ঢাকায় এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) যেখানেই দেখবে সেখানেই তাদের ধ্বংস সাধন করবে। দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) দমনে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীকে এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আমরা সবার প্রতি অনুরোধ জানাই।’ ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মওলানা নূরুজ্জামান খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) দমনে নিয়োজিত। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা দেশরক্ষায় তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করুন।’ সমস্ত সিলেট জেলা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকসেনারা সিলেট বিমান বন্দর ও লাক্কাতুরা চা-বাগানের আশপাশে একত্র হয়। বিকালে পাকসেনারা নড়াইল-যশোর রোড দাইতলা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যুহতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকসেনারা টিকে থাকতে না পেরে পশ্চাদপসারণ করে চলে যায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর আনুমানিক ৩০ জন নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হয়নি। পার্বতীপুরের বিহারীরা নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে ব্যাপকহারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নীলফামারী পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা খানসামাতে ডিফেন্স নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনার দখলকৃত খুলনা রেডিও স্টেশনের ওপর আক্রমণ চালায়। রাতব্যাপী এ যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎবরণ করেন। পাকসেনারা খুলনার দৌলতপুরের রঘুনাথপুর গ্রামে হামলা চালায় এবং সেখানে বহু লোককে হত্যা করে। ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান অফিসার ও প্রশাসক নিয়োগ সম্পর্কিত ‘সামরিক আইন বিধি ১৩৭’ জারি করে। ‘গুরুত্বপূর্ণ রেল শহর পার্বতীপুর মুক্ত’ এ শিরোনামে সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা সংবাদ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যশোর সদরের ৮ মাইল পূর্ব-উত্তর কোণে লেবুতলা নামক গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল গুলিবিনিময় হয়। কয়েক ঘণ্টার এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৫০ জন সৈন্যের মৃত্যু ও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ১৭ নং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল মেঘ সিং, বিএসএফের অফিসারসহ দুটি কোম্পানি পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে ঝিকরগাছা লাওজান গেটের কাছে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। নীলফামারীতে পাকসেনারা পূর্ণ সামরিক সম্ভারসহ সুবেদার মজিদের বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতি স্বীকার করলেও অটুট মনোবল নিয়ে দেবীগঞ্জে এসে ডিফেন্স নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে দিনটি স্মরণীয়। এদিন ‘দৈনিক বাংলাদেশ’ নামে একটি সংবাদপত্রের প্রকাশ ঘটে। ঠাকুরগাঁও ওয়াপদার কর্মকর্তা কাজী মাজহারুল হুদা-পূর্বের বেশ কয়েকদিনের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সময়ের তাগিদে জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও ফ্রন্টলাইনের খবরসহ মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিশ্বজনমত তুলে ধরার ব্যাপারে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেন। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সুলেখা প্রেস থেকে ১/৮ ডিমাই সাইজের ৪ পৃষ্ঠার ৫০০ কপি পত্রিকা ছাপানো হয়। মূল্য ছিল ১০ পয়সা। একটি সংখ্যার ব্যানার হেড ছিল ‘গণচীন একটি কাগুজে বাঘ’ যা আকাশবাণী থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ করেছিলেন ও পত্রিকাটির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন কালুর ঘাট থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সহযোগী সশস্ত্র অবাঙালীদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ২১ জনকে হত্যা করে। পাকবাহিনী সাঁজোয়া বহর নিয়ে লালমনিরহাট এবং রংপুর থেকে এসে মিলিত হয়ে একযোগে কুড়িগ্রামের দিকে গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়। বিকেলের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতুল প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। তারা বর্তমান সার্কিট হাউসের সামনে এসে পজিশন নিয়ে গোলাবর্ষণ করে। সে সময় জেলখানার কর্তব্যরত ইনচার্জ ও পাঁচজন সিপাহীকে পাকবাহিনী হুইসেল বাজিয়ে ডেকে নেয় এবং সার্কিট হাউসের (বর্তমানে নির্মিত) সামনের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। ব্রাশ ফায়ারে শহীদ হন লাল মোহাম্মদ, আনসার আলী, সাজ্জাদ আলী ও জহির উদ্দিন। গুরুতরভাবে আহত জেল-ইনচার্জ শেখ হেদায়েত উল্লাহ ওইদিন রাত এগারোটায় মারা যান। বাকি একজন সিপাহী আব্দুল জলিল গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। পাকবাহিনী ওইদিনই কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে তিস্তার দিকে চলে যায়। জেল-ইনচার্জের স্ত্রী জেলখানার তালা খুলে দিলে হাজতীরা বের হয়ে পালিয়ে যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×