মোঃ দলিল উদ্দিন দুলাল ॥ বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতার ১৯৭১। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উন্মাদনার সৃষ্টি ’৭১-এর মার্চ মাস। আমরা যারা রণাঙ্গনের সৈনিক তাদের কাছে সেই দিনগুলোর স্মৃতি আজও অম্লান। মনে পড়ে আমরা পাবনা জেলার পূর্বপ্রান্তে কাশিনাথপুর। চৌরাস্তা তিন থানার মোড় মানুষ জড়ো হয়ে জটলা সৃষ্টি করে সবাই স্লোগাানের সোচ্চার। মাঝে মধ্যে ঢাকা থেকে ফেরির গাড়ি এলে সবাই দাঁড় করিয়ে ঢাকার খবরা খবর নিতে ব্যস্ত। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরের দিন ৮ মার্চ রেডিও এর মাধ্যমে শোনো হলো। গ্রামের ডাক্তার শচিকান্তের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। মারফি রেডিও কাঁপছিল বঙ্গবন্ধু ভাষণের সময়। লোকজন একত্রিত হয়ে ভাষণ শোনার পর জয়বাংলা স্লোগান স্বাধীন বাংলার স্লোগান দেয়া শুরু করল। সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া থানার মিলন স্থান কাশিনাথপুর। ঢাকা, পাবনা, রাজশাহী এবং সিরাজগঞ্জ থেকে সড়ক যোগাযোগ এই কাশিনাথপুর। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের ক্যাম্প করা হয়। ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন, তখনকার এমএনএ অধ্যাপক আবু সাইদ। এলাকার তরুণ সমাজ যুদ্ধের ট্রেনিং শুরু করেছিলেন। আমাদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার কৌশল প্রশিক্ষণ দিত পাকিস্তানী আর্মি থেকে ছুটিতে আসা মোবারক। সৈয়দপুর, আহম্মদপুর, রাণীনগর, রূপপুর মাশুমদিয়া জাদসাকিন, ইউনিয়নে যথাক্রমে দলিল উদ্দিন দুলাল, আব্দুর সামাদ, ফকরুল আলম ঝিনাহ, আব্দুল গফুর, আব্দুল হামিদ, আব্দুল কাদের, তখনকার দিনের পাবনা জেলার ছাত্রলীগ নেতা, এদের নেতৃতে স্ব-স্ব এলাকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেরুয়ারি বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিবাদ করায় কাজিরহাট হাইস্কুল থেকে হরতালের আহ্বান করে মাসুম দিয়া, রূপপুর, সাগরকান্দি প্রতিটি ইউনিয়নে হরতাল পালন করা হয়। আমাকে সহায়তা করে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র সিরাজুর রহমান খান, সাইদুর রহমান খান (রাজশাহী ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি এবং লন্ডনের এ্যাম্বাসেডর) আমাদের ৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয় এবং আমাকে ওইদিনে গভীর রাতে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাবনা জেলহাজতে সেখানে পেলাম ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, রনেশ মৈত্র ও আরও অনেকে। মুসলিম লীগের দাপটে আমরা সবসময় নির্যাতিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাঙালীরা স্বস্তি পেল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা সবাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি, অনেক বন্ধুরা আজ আদর্শচ্যুত হয়েছে। অনেকে ইন্তেকাল করেছেন। আমি এখন মৃত্যুর কাটগড়ায় দাঁড়িয়ে দেখছি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতা। এমন অনেকেই আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেননি তারাই এখন বড় বড় কথা বলেন। ’৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, ভাতৃপ্রতীম সম্পর্ক ছিল। সে সময়ের সহযোদ্ধারা আহত হলে তার লাশ কাঁধে নিয়ে ফিরত। তখনকার দিনের সম্পর্ক আদর, স্নেহ, সম্মান এখনও অনেকে দেখায়। এমন অনেককে দেখি, কয়দিন আগেও যারা জিন্দাবাদ বলত এখন তাদের মুখে জয়বাংলা আর গায়ে মুজিবকোট। তাদের সঙ্গে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এখন মুখোমুখি। এটা সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে আদর্শের, সমস্যা হচ্ছে সম্মানের। এক সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যারা আঁস্তাকুড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আজ তারাই আঁস্তাকুড়ে চলে গেছে। তাদের ঠেলে দেয়া হয়নি। তাদের আচরণে চলে গেছেন আজ ডাস্টবিনে। তাদের কর্মের ফলেই এটা হয়ে থাকে এবং এটাই তাদের বিধির বিধান।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা
শীর্ষ সংবাদ: