ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

কাঠামোগত বৈষম্য- রূপান্তর না কি নিয়ন্ত্রণ?

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৭ এপ্রিল ২০১৯

কাঠামোগত বৈষম্য- রূপান্তর  না কি নিয়ন্ত্রণ?

পৃথিবীর নানা প্রান্তের সমাজে যেসব সামাজিক কাঠামোগত বৈষম্য আছে সেগুলোকে এক বাক্যে গুছিয়ে এনে ‘কাঠামোগত সহিংসতা’ বলে উল্লেখ করেছেন একজন জগতবিখ্যাত চিকিৎসা নৃতাত্ত্বিক পল ফারমার। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সম্মানিত এই শিক্ষকব্যক্তিত্ব মনে করেন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হলো আধুনিক ওষুধের হৃদয়, যেখানে আত্মাকে স্থাপন করতে হবে। যদি এই সূত্রকে আমরা জীবনের নানা বৈচিত্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই মানবসমাজ বিকাশের নানা পর্যায়ে কাঠামোগত যে রূপান্তর সেখানে নেতিবাচক সহিংসতা ও বৈষম্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ালেও মানবসমাজ প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে সেসবের মোকাবেলা করেছে ও নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের গতি যেভাবে বহমান তাকে সমানতালে সুদৃঢ় করে এগিয়ে নিতে ও সেসব উন্নয়নের চূড়ান্ত সুফল পেতে হলে আমাদের কাঠামোগত সহিংসতার অনুষঙ্গগুলো ভালভাবে বুঝে নিতে হবে। যেমন ধরুন- একজন মানুষের ক্যান্সার হলো, অপরদিকে সরকারের উদ্যোগে ও নানা প্রচেষ্টায় আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা আরও উন্নত হলো, কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্ত হলো যেহেতু ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি ও বাঁচার সম্ভাবনা কম তাই তাকে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়ার কোন দরকার নেই। এতে অর্থের অপচয় ও পরিবারের পেরেশানি বাড়বে। একে পল ফারমার বলছেন সামাজিক কাঠামোগত সহিংসতা, যা তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিভিন্ন সমাজও সমর্থন করে। বিশেষ করে নারীদের বেলায়। ধরুন, আমাদের দেশে হরহামেশা যেসব অভিযোগ আমরা পাই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে, যেমন,-তিনি কোন কথাই শুনলেন না, ভাল করে রোগের সমুদয় বিবরণ জানতে চাইলেন না, মিনিটে একগাদা ওষুধ বা পরীক্ষা দিয়ে দিলেন, এরকম ক্ষেত্রেও এটা প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা বলে পল ফারমার মনে করেন, যা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও নিজেদের চিকিৎসা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। To Repair the World নামে পল ফারমারের একটি বক্তৃতা সঙ্কলন আছে, যেখানে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে এরকম স্বাস্থ্য মানবতাবাদের নানা প্রসঙ্গের বিশদ বিবরণ আছে। বাংলাদেশের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন-উৎকর্ষের মৌলিক লক্ষ্য ডিজিটাল স্তরে উন্নীত হতে আমাদের বর্তমান যে অর্জন তা নিমিষে শেষ হয়ে যাবে যদি আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে কোন পরিবর্তন আনতে না পারি। দুনিয়াজুড়ে উন্নয়ন প্রকৃতির একটি সুসংহত নেতৃত্ব পরিচালিত হচ্ছে জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অনুসরণ করে। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরোধে ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সব দেশকে একমত হতে খোদ জাতিসংঘের সময় লেগেছিল ২০ বছর (১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে প্রথম নারী সম্মেলন, ডেনমার্কে ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়, কেনিয়ায় ১৯৮৫ সালে তৃতীয় ও চীনে ১৯৯৫ সালে চতুর্থবারের মতো সম্মেলন করতে হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে সবাই একমত হতে)। এখনও কি সেই ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকার দেশে দেশে সমানভাবে নারীদের জন্য পূরণ হয়েছে? পল ফারমার মনে করেন, সমাজে যতরকম বৈষম্য আছে তার প্রধান শিকার হয়ে থাকেন নারীরাই। অথচ মোট উৎপাদন শক্তিতে নারীর অংশ পুরুষের পাশাপাশি একেবারেই সমান সমান। ঠিক সেরকম জাতিসংঘের ধরিত্রী সম্মেলন যা ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে হয়েছিল তার সকল অঙ্গীকারের বিশেষ করে ‘এজেন্ডা ২১’ বলে যা সকলের কাছে পরিচিত সেসবের ধারাবাহিক আলোচনা বা ফলোআপ আজও চলছে। কিন্তু পরিবেশ প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিশ্চিত করে একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর সম্মান আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। ১৯৭৮ সালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমাআতা অঙ্গীকার যেটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তাতে এখনও দুনিয়ার সব দেশে স্বাস্থ্য বৈষম্য দূর করে স্বাস্থ্য মানবতার সম্মান আমরা অর্জন করতে পারিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম সূত্রধর জাতিসংঘের বিশ্ব তথ্য সমাজ ঘোষণাপত্র (২০০৩ সালে জেনেভায় গৃহীত হয়েছিল ও ২০০৫ সালে সব সদস্য দেশ তিউনিস সম্মেলনে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল) যা বাংলাদেশ জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে কিন্তু অঙ্গীকারবদ্ধ সব দেশ এখনও সেসব অঙ্গীকারের ধারে-কাছে নেই। ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রাণপাত চেষ্টা করেও অনেক উন্নত দেশের প্রযুক্তি সেবার সমান অধিকার পাচ্ছে না বা অনেক মূল্য দিয়ে তার অধিকার কিনে নিতে হচ্ছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত সহিংসতার একটি বিশেষ রূপ বা উদাহরণ। অপরদিকে উন্নত দেশগুলোকে প্রযুক্তি বৈষম্য কমাতেও পাশে পাচ্ছে না। এসবের প্রধান কারণ বৈশ্বিক উন্নয়ন মনোজগতের কূটকৌশল, যেসবের রাজনৈতিক অর্থনীতির শিকার হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। ফলে আমরা যে সমান্তরাল দৃষ্টিকোণে বিরাজমান বৈষম্য দেখি তার ভিত্তি সবচেয়ে উঁচু দেশ থেকে নিচের সব দেশেই বিদ্যমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব ক’টি সুবিধায় যদি আমরা কল্যাণের আত্মা স্থাপন করতে না পারি তাহলে পুঁজির বিকাশ আমাদের এক সময় এমন এক জায়গায় এনে থামিয়ে দেবে যা হয়ত মুখরোচক গল্প হিসেবে কিছুদিন সমাজে আবর্তিত হবে, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যাবে আসবে না। যেমন ধরুন, অতি সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা ও সবচেয়ে বড় ধনী বলে যে মানুষটিকে আমরা জানি, যিনি টাকা-পয়সা কামাতে কামাতে জমিয়ে রাখার আর কোন ব্যাংক খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেই জেফ বেজোস তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিলেন আর তাতে খেসারত দিলেন ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের টাকায় ৩ লাখ কোটি টাকা। একটি পরিবারের বিবাহ বিচ্ছেদের টাকা যদি আজকের এই কল্যাণের যুগে এই পরিমাণ হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই পল ফারমারের সঙ্গে একমত হতেই হবে যে- দুনিয়ায় এখন প্রাতিষ্ঠানিক আর সামাজিক বৈষম্য অনেক বেশি সহিংস হয়ে উঠেছে। আমরা এখনও জানি না জেফের স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি তালাকের ওই টাকা দিয়ে আদৌ দুনিয়ায় কল্যাণের জন্য কিছু করবেন কী না। উন্নয়ন অর্থনীতি এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখানে বিশ্ব নেতাদের খুব কমই আছেন, যারা কল্যাণ অর্থনীতির জন্য ধনী দেশগুলোকে বা ব্যক্তিদের চাপ বা পরামর্শ দেবেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ইতোমধ্যে নিজের দক্ষতা একইসঙ্গে কল্যাণ চিন্তার ব্যবস্থাপনায় প্রমাণ করেছেন নেতৃত্বকে মানবিক হতে হলে অনেক টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়তে হয় না। বাংলাদেশের উন্নয়ন সমাজ এখন যেরূপ গতির নির্দেশনা পাচ্ছে তাতে তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন দেশের সম্পদের কল্যাণমুখী বিকাশ, যা নতুন এক মানবিক দর্শন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এতে সন্দেহ নেই দেশের বিকাশমান নেতৃত্বের দায়িত্ব বেড়েছে বেশি, আর তাতে সঙ্গে নিতে হবে জনগণকেই। অনেকে বলেন জনগণের চিন্তা প্রভাব সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় জ্ঞান সমাজের মাধ্যমে। এটা ভুল। অন্তত বাংলাদেশের বাস্তবতায় এরকম সুশীল প্ররোচনা নিকট অতীতে খুব একটা কাজ দেয়নি। দেশের যা কিছু উন্নয়ন তা হতে হবে একক নির্দেশনায়; কিন্তু সমন্বিত রাজনৈতিক কৌশলে, যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন। বঞ্চনার দেশ বাংলাদেশ; কিন্তু সে তো উঠে দাঁড়িয়েছে। সেই দেশে এখন আর কোন সামাজিক কাঠামোগত বৈষম্য বা সহিংসতা বিস্তার লাভের সুযোগ হবে না, যদি জনগণ এই সত্য উপলব্ধি করতে পারে যে, এই একই ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ যে কল্যাণমুখী সমাজ আমরা তৈরি করে নিয়েছি সেখানে অন্যকে ঠকিয়ে বা ঠেকিয়ে নিজে নিজে বড় হয়ে যাব এই চিন্তা আর টিকবে না। বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ডিজিটাল সক্ষমতা, বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা ও ঐতিহ্য সম্মানের কৃষ্টি আমাদের এখন এমনই এক জায়গায় পৌঁছে দিতে সক্ষম, যা পল ফারমারের পরবর্তী রচনায় ঠাঁই পেতে পারে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×