ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ুদূষণে প্রতি দশজনে একজন মারা যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ৬ এপ্রিল ২০১৯

বায়ুদূষণে প্রতি দশজনে একজন মারা যাচ্ছে

শাহীন রহমান ॥ বায়ুদূষণের তালিকায় আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বারবারই উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণে রাজধানী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছেÑএর অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিশেষ করে এমনভাবে শহর গড়ে তোলা হয়েছে যে গ্রীন হাউস গ্যাসের মতো ঢাকা শহরে আটকে পড়ছে দূষিত বাতাস। এই দূষিত বায়ু বের হতে না পারাই বিষাক্ত গ্যাস ধুলাবালিযুক্ত বাতাস ঘুরেফিরে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এছাড়া ইটভাঁটির মাধ্যমে বায়ুদূষণ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়াচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় অনুমোদনহীন গাড়ি গ্রাম্য জনপদে বেশি চলাচল করছে। ফলে এসব গাড়ির কালো ধোঁয়ায় বায়ু দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে দূষণ চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ইটের ভাঁটি, পুরনো গাড়ি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণ মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কার্বনডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে একদিক থেকে বাতাস ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হতে পারে না, সরু রাস্তা ও হাইরাইস বিল্ডিংয়ের কারণে। বিষাক্ত গ্যাস, ধুলাবালিযুক্ত বাতাস ঘুরেফিরে মানুষের শরীরেই ঢুকছে। তারা বলেন, সরকারের যারা নীতি-নির্ধারক আছেন তারা কোন রকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়াই যে কোন কাজ হুটহাট করে বসেন। সরকার ২০ বছরের পুরনো আইন দিয়েই বর্তমান পরিবেশ নীতি পরিচালনা করছে। এই আইন সে সময়ের জন্যই প্রযোজ্য ছিল, বর্তমানে এ আইন অকেজো। তাই সরকারকে অতিদ্রুত পরিবেশ আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাঁটির কারণে বায়ু দূষণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। নিয়মনীতি না মেনেই যেখানে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাঁটি। এমনকি অনেক পল্লী অঞ্চলে প্রাইমারী স্কুলের পাশেও ইটভাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে শিশুরা মারাত্মক দূষণের কবলে পড়ছে। ইটভাঁটির জ্বালানি ও পরিবহনের জন্য দূষণ বাড়ছে গ্রামে। প্রতিনিয়তই ট্রাক, নসিমন, করিম ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব যানবাহন পরিবেশবান্ধব নয়। ডিজেলচালিত এসব পরিবহন থেকে নির্গত ধোঁয়াও গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে বায়ু দূষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামের যাতায়াত এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় এখন সারাক্ষণই ইঞ্জিনের গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে। ইঞ্জিনচালিত এসব গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। এভাবেই বায়ু দূষণ সারাদেশে বড় সমস্যা হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার নামে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের দেশের বায়ু দূষণ নিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন না কোনভাবে বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ বায়ু দূষণের শিকার। এ কারণে দেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার। আর ভারত ও চীনে মারা যাচ্ছে ১২ লাখ। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ’১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের একজন মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। বায়ু দূষণের শিকার হয়ে যে দশ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ নাইজিরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব রাষ্টের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তারা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানে মৃত্যুহারের তুলনায় ’১৭ সালে বায়ু দূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। পাশাপাশি বয়স্করাও বায়ু দূষণজনিত জটিল রোগের ভুগছেন। পরিবেশ অদিফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলীর আব্দুস সোবহান বলেন, শিশুরা মূলত ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসে বাতাসের দূষিত কণা তাদের দেহে প্রবেশ করছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বে প্রতি বছর বায়ু দূষণে ৫ বছর বয়সী ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয় বিশ্বের ৩০ কোটি শিশু নারী এমন এক এলাকায় বাস করছে যেখানকার বায়ু অত্যধিক দূষিত। এর মধ্যে ২২ কোটি শিশুরই বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় ২৫ ভাগ শিশু এবং ৫০ ভাগ বয়স্ক মানুষ বায়ু দূষণের কারণে ফুসফুসের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। পরিবেশবিষয়ক চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ু দূষণের অর্থ বাতাসে ভাসমান কণা এবং বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। দূষণ বাড়লে যে শ্বাসরোগ এবং ফুসফুসের দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়তে পারে এ কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে শুধু ফুসফুস বা শ্বাসনালী নয় বায়ু দূষণ শরীরের বেশিরভাগ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরই প্রভাব ফেলে। ফলে ক্যান্সার, হৃদরোগ এমনকি অবসাদ দেখা দিতে পারে। তাদের মতে, শুধু ফুসফুস নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্যান্সারের জন্য বায়ু দূষণ অনেকাংশে দায়ী। একই কথা প্রযোজ্য হৃদরোগের ক্ষেত্রেও। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম সবচেয়ে বড় হুমকি হলো বায়ু দূষণ। এটাকে এইচআইভির ঝুঁকির চেয়ে বেশি ঝুঁকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তরুণদের ওপর এর প্রভাব খুবই ভয়াবহ। তারা বলছে, বিশ্বের নব্বই শতাংশ মানুষ যে বায়ুতে নিশ্বাস নিচ্ছে তাতে দূষণের মাত্রা বিশ্ব¦ স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাঁচ বছরের নিচে ৫ লাখ ৭০ হাজার শিশুর অকালমৃত্যুর জন্য দায়ি বায়ু দূষণজনিত রোগ ব্যাধি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের প্রভাবে শহরাঞ্চলের মানুষের মৃত্যু বেশি ঘটছে। বায়ু দূষণের কারণে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরপর ধীরে ধীরে মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। তারা বলেন, বায়ু দূষণের প্রভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এর সরাসরি প্রভাব না থাকায় সরকার এবং সাধারণ মানুষ এটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর শতকরা ২১ ভাগ ঘটছে শহর এলাকায়। যা এক দশক আগের তুলনায় ১১ গুণেরও বেশি। পরিবেশ সংগঠন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ বলেন, দূষণ চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ইটের ভাঁটি, পুরনো গাড়ি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণ মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কার্বনের মতো বিষাক্ত গ্যাস আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। ঢাকা শহরে একদিক থেকে বাতাস ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হতে পারে না, সরু রাস্তা ও হাইরাইস বিল্ডিংয়ের কারণে। বিষাক্ত গ্যাস, ধুলাবালিযুক্ত বাতাস ঘুরেফিরে মানুষের শরীরেই প্রবেশ করছে। সরকারের যারা নীতি-নির্ধারক আছেন তারা কোন রকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়াই যে কোনো কাজ হুট-হাট করে বসেন। সরকার ২০ বছরের পুরনো আইন দিয়েই বর্তমান পরিবেশ নীতি পরিচালনা করছে। এই আইন সেই সময়ের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। বর্তমানে এ আইন অকেজো। তাই সরকারকে অতিদ্রুত পরিবেশ আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করতে হবে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলেন, বর্তমানে দেশের পরিবেশের যে সঙ্কট রয়েছে তা বাপাকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিনিয়ত মারাত্মক শব্দদূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, দৃষ্টি দূষণসহ নানাবিধ সমস্যায় নিপতিত আজকের সামগ্রিক পরিবেশ। পরিবেশের যে কোন সঙ্কট সমাধানে সরকারের আগ্রহ সব সময়ই কম। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের দৈন্য খুবই দুঃখজনক। তিনি আইন বাস্তবায়নে সরকারকে নীতিনিষ্ঠ ও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান।
×