ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এরা অস্ত্রের যোগান পাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে

চার সশস্ত্র গ্রুপ পাহাড় অশান্ত করছে, ঝরছে রক্ত

প্রকাশিত: ১০:১২, ৬ এপ্রিল ২০১৯

  চার সশস্ত্র গ্রুপ পাহাড় অশান্ত করছে, ঝরছে রক্ত

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের অস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎস বন্ধ ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপকে গ্রেফতারের মাধ্যমে পাহাড়ে রক্তঝরা বন্ধে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার। রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ দুর্গম পাহাড়ে বর্তমানে জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এই চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় বলে গোয়েন্দারা মনে করেন। এই চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের কারা কিভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান দিচ্ছে তার খোঁজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের অস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎস বন্ধ ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপকে গ্রেফতারের মাধ্যমে পাহাড়ে রক্তঝরা বন্ধের নির্দেশ দেয়ার পর পাহাড়ী এলাকায় বিশেষ অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী বিজিবি র‌্যাব পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, পার্শ¦বর্তী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাচ্ছে দেশের পাহাড়ী এলাকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। সশস্ত্র গ্রুপগুলো স্বাধীনতা, স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি আদর্শ প্রচারের নামে পাহাড়ে সংগঠিত হয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন করে পাহাড়ী জনপদ অশান্ত করে তুলছে। এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে সাধারণ মানুষ এখন জিম্মি। রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের, নাইক্ষ্যংছড়িসহ দুর্গম পাহাড়ে ভারি আগ্নেয়াস্ত্রের এতই ছড়াছড়ি যে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় ৭ জন প্রকাশ্যে খুন হয়েছে। দিবালোকে এই সাতজনকে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে খুন করা হয়েছে। বুধবার একজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। গ্রুপগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি বিপন্ন হচ্ছে পাহাড়ী জনপদ। এসব অস্ত্র কোথা থেকে কারা যোগান দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহম্মদ বলেছেন, উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্ব শেষে ফেরার পথে গত ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় ৭ জন নিহত হওয়ার পর ওই সন্ত্রাসী গ্রুপটি বান্দরবান সীমান্তে গা ঢাকা দেয় এমন খবর ছিল যৌথবাহিনীর কাছে। সে সময় ঘটনাস্থল থেকে এসএমজি ও একে-৪৭ রাইফেলের গুলির খোসা উদ্ধার হয়। গত বছর ১৯ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর বাজার এলাকায় ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ী ছাত্রপরিষদ-পিসিপির সভাপতিসহ নিহত হয় ৭। এর আগে ১৩ জুলাই খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন। একই দিনে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ইউপিডিএফ কর্মী জ্ঞানেন্দু চাকমার লাশ নিতে এসে তার ছোট ভাই কালায়ন চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আগের দিন জ্ঞানেন্দু চাকমা নিহত হন। এই ঘটনায় জেএসএসকে দায়ী করে ইউপিডিএফ। গত ৩ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তি চাকমাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা ’১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে গঠিত নতুন দলে যোগ দেন। ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, একই দলের নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা ও টনক চাকমা। তাদের বাঙালী গাড়িচালক সজীবও নিহত হয়। ওই ঘটনার মাস তিনেক আগে নিহত হয়েছেন ইউপিডিএফের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্রপরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমা। এদিকে গত ১৮ এপ্রিল রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এসএমজি ও এ্যাসল্ট রাইফেলসহ পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি লামা থেকে ২৫ আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই হাজার গুলিসহ চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনী র‌্যাব ও পুলিশ। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি পাহাড়ের কূপে সম্প্রতি পাওয়া গেছে ৬৩৩ রাউন্ড ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি, ৫৪ বিমান বিধ্বংসী গোলা আর একটি মেশিনগানের ব্যারেল। ওই পাহাড়ের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরিত্যক্ত ঘর ও বালির বস্তা দিয়ে তৈরি নিরাপত্তা বাঙ্কারের আলামতও পাওয়া গেছে। ওই পাহাড়ের পূর্বদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বহু পরিত্যক্ত বাড়িঘর পাওয়া গেছে। এর আগেও র‌্যাব ওই পাহাড় থেকে চারটি মেশিনগান, একটি রকেট লঞ্চার, মেশিনগানের পাঁচটি ব্যারেল, ২২২ কামানের গোলা ও তা ছোড়ার কাজে ব্যবহৃত ২৪৮ চার্জ এবং বিভিন্ন ধরনের ২৫ হাজার গুলি উদ্ধার করে। যে স্থানটিতে এই গোলাবারুদ পাওয়া গেছে, তা এক সময় অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্সের (এটিটিএফ) আস্তানা ছিল বলে মনে করা হয়। অল ত্রিপুরা টাইগার্স ফোর্স ছাড়াও রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ির বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ভারতের উলফাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর যোগসাজশ রয়েছে। তারাই বাংলাদেশের পাহাড়ে আগ্নেয়াস্ত্রের যোগান দেয়। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, পার্শ্ববর্তী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের পাহাড়ে অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে। পাহাড়ে বর্তমানে জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে যে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় তাদের হাতে মানুষ এখন জিম্মি। এরা আধিপত্য বিস্তার, হত্যা, সন্ত্রাস, অপহরণ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পাহাড়কে অশান্ত করে। তারা প্রায়ই হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে। এজন্য সেনাবাহিনী র‌্যাব পুলিশ বিজিবি গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড় রক্তঝরা বন্ধ করে পাহাড়ী জনপদকে শান্ত রাখার লক্ষ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছে।
×