ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় গণসঙ্গীত উৎসব শুরু

বিভেদের কূটচাল ভেঙে সংগ্রামী ঐক্য, মানবতার ডাক

প্রকাশিত: ১০:১০, ৬ এপ্রিল ২০১৯

বিভেদের কূটচাল ভেঙে সংগ্রামী ঐক্য, মানবতার ডাক

মোরসালিন মিজান ॥ গণসঙ্গীতের এত বড়, এত বিশাল আয়োজন দেখে সত্যি অবাক হতে হলো। এ ধারার সঙ্গীত শুধু তো সঙ্গীত নয়, সংগ্রামের সুকঠিন হাতিয়ার। হাতিয়ারে ধার কমেছে, হয়ত কমেছে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। আজকের বাংলাদেশ কিংবা বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে নিলে গণসঙ্গীত বাঁচিয়ে রাখার, নতুন নতুন কথা ও সুর সৃষ্টির প্রয়োজন স্পষ্ট হয়। আর এ প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় নিয়েই জাতীয় গণসঙ্গীত উৎসবের আয়োজন। শুক্রবার থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজক বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ। পরিষদ অনেক দিন ধরেই গণসঙ্গীতের প্রসারে কাজ করছে। দেশের প্রায় সব বিভাগীয় শহরে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে ইতোমধ্যে। তার চেয়ে বড় অর্জন- বহু জেলায় শিল্পীদের সংগঠিত করে গণসঙ্গীতের দল গড়ে তোলা। ঢাকার বাইরের এসব দল উৎসবে যোগ দিয়েছে। বিকেলে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে তিন দিনব্যাপী আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় জাতীয় গণসঙ্গীত উৎসবের চাওয়া- মানবিক মানুষের ঐক্য। এই চাওয়ার কথা জানিয়ে স্লোগানে বলা হয়েছে, ‘বিভেদের কূটচাল ভেঙে করো চুরমার/ সংগ্রামী ঐক্যে মানবতা জাগবেই।’ গানে গানেও ছিল জাগিয়ে তোলার আহ্বান। এদিন মূল মঞ্চের পাশে নির্মিত আরেকটি মঞ্চ থেকে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন গণসঙ্গীতের-ই মানুষ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। তার পাশেই ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন গণসঙ্গীতের সরব কণ্ঠ ফকির আলমগীর, সংগঠক গোলাম কুদ্দুছ ও মানজার চৌধুরী সুইট। মূল মঞ্চে তখন ৬০ জনের মতো শিল্পী। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ পোশাকে সেজে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন। সম্মেলক কণ্ঠে প্রথমে তারা গাইলেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। পরের গানটি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়।’ শিল্পীরা গাইলেন। তাদের সঙ্গে গাইলেন বিশিষ্টজনেরা। মঞ্চের সামনে প্যান্ডেলের নিচে গণসঙ্গীতের শত শত ভক্ত অনুরাগী। তারাও কণ্ঠ মেলালেন। এভাবে বেশ আবেগঘন শুরু। মূল মঞ্চের সামনের অংশটিকেও আয়োজকরা সুন্দর ব্যবহার করেছেন। এখানে যাদের হাত ধরে গণসঙ্গীতের ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তাদের প্রতিকৃতি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, মুকুন্দ দাস, সত্যেন সেন, ভূপেন হাজারিকার মতো শিল্পীদের স্মরণ করা হচ্ছে। রাখা হয়েছে আবদুল লতিফ, শেখ লুৎফর রহমানের প্রতিকৃতি। জর্জ হ্যারিসন বব ডিলাল পল রবসন কেউ বাদ জাননি। ছবিগুলোর সামনে লাল কার্পেটে এক ধরনের বেদি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতার বোধ আর ভালবাসার বহির্প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন কামাল লোহানী। গণসঙ্গীতের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য, লড়ে নেয়ার জন্য গণসঙ্গীত। একসময় ধারণা হয়েছিল, আমরা তো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, গণসঙ্গীত আর দরকার হবে না। ভুল কথা। এই দেশকে গড়ার জন্য গণসঙ্গীতের প্রয়োজন আছে। বহুকালের পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার সময় এই দেশের মানুষ অখন্ড ভারতের মানুষ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের জন্ম দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সংঘ কী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, আমরা তা জানি। নাচ গান নাটক আবৃত্তির ভেতর দিয়ে তারা প্রবল প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। চল্লিশের দশকে যার জন্ম, তেতাল্লিশে যখন দুর্ভিক্ষ হলো তখন তারা ‘ভুখা হে বঙ্গাল’ বলে আবেগতাড়িত কণ্ঠ নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হলো। আমরা দেখেছি, ১৯৪৬ সালে যখন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হলো, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হলো, তখন গণসঙ্গীত শিল্পীরা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়ে গাইলেন ‘রাম রহিম না জোদা করো।’ অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করো না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মুসলিম লীগ আর জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু হয়ে দুটি রাষ্ট্র চেয়ে নিয়েছিল। তিনি বলেন, যে পাকিস্তান কামনা করে আমরা গণভোট দিয়েছিলাম সেটা ছিল একটা মোহ। আর তাই মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে আক্রান্ত হলো আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। এর বিরুদ্ধে অমিততেজ সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠল। আমরা চিৎকার করে গাইতে থাকলাম: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...। সমস্ত মানুষকে আবেগতাড়িত করল এই গান। আইয়ুব খানের সময় আমরা গেয়েছি, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা-/আজ জেগেছে এই জনতা।’ একই সময় ছাপ্পা ভোটের প্রতিবাদে সিকান্দার আবু জাফর লিখলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই/জনতার সংগ্রাম চলবেই।’ আরও পেছনে গিয়ে তিনি বলেন, ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হলো তখন দেখছি গণনাট্য সংঘ গাইছে: ‘আজি বাংলার বুকে দারুণ হাহাকার।’ সলিল চৌধুরীর মতো শিল্পী জলপাইগুড়ির বিশাল সমাবেশে যখন এ গান গাইছেন তখন শ্রোতারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের জল মুছছেন। পরের লাইনটি শুনিয়ে তিনি যখন গাইলেন ‘না না না এমন করে শুকিয়ে মরা চলবে না’, তখন একই সমাবেশ প্রতিবাদী স্পৃহা নিয়ে জেগে উঠল। এভাবে যুগে যুগে গণসঙ্গীত মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে বর্তমানের আলোচনায় এসে কামাল লোহানী বলেন, গণসঙ্গীতর যে ধার ছিল, আজ তা নেই। অনেক অন্যায় হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। আমরা প্রতিবাদ করতে পারছি না। আজকের অনুকূল পরিবেশে সে সাহস আমরা দেখি না। সরকার ভুল করলে সেই ভুলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, জনগণকে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সরকার বিপথে গেলে বুঝিয়ে দিতে হবে, এটা ঠিক নয়। এ জন্য কণ্ঠকে শাণিত করার আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হাছান মাহমুদ সঙ্গীত বা গণসঙ্গীতের নন। তবে ভাল বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন, গণসঙ্গীত মানুষকে আন্দোলিত করে, সংগঠিত করে। প্রতিবাদী করে। সংগ্রামে ব্রতী করে। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিরাট ভূমিকা রেখেছে এই ধারার সঙ্গীত। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচনার ক্ষেত্রে গণসঙ্গীতের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণসঙ্গীত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। গণসঙ্গীত উৎসব সারাদেশে আয়োজন করারও পরামর্শ দেন মন্ত্রী। গণসঙ্গীত নিয়েই থাকা যার, সেই ফকির আলমগীর কথা বলেন কামাল লোহানীর বক্তব্যের সূত্র ধরে। কামাল লোহানী যেসব গণসঙ্গীতের কথা উল্লেখ করেন সেসব ভুলে যাওয়া গানের অংশ বিশেষ গেয়ে শোনান তিনি। এ পর্বটি সত্যি অন্যরকম ছিল। তার কণ্ঠে শোনা হয় ‘জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম লাগলো দেশে ধুম।’ একইভাবে তিনি গেয়ে শোনানÑ মোরা কি দুখে বাঁচিয়া রব/উজিরে নাজিরে বাঁচায়া রাখিতে চিরউপবাসী হবো/মোদের বামে মহারানী ডানে মার্কিনী সমুখে অগাধ জল...। ঊনসত্তর সালে তরুণ সাধন ঘোষের একটি বিখ্যাত গানের কথা তিনি নিজে উল্লেখ করলেন। গাইলেন, বাংলার কমরেড বন্ধু এইবার তুলে নাও হাতিয়ার... গণযুদ্ধের ডাক এসেছে...। খালি গলায় গাওয়া গণসঙ্গীত ফেলে আসা স্বর্ণযুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আগে স্বাগত বক্তব্যে উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছ বলেন, কালের পথযাত্রায় গণসঙ্গীতের প্রেক্ষিত হয়ত বদলে গেছে। প্রাসঙ্গিকতা হয়ত নতুন নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু এর গৌরব, ইতিহাস, এর প্রয়োজনীয়তা কোনটাই ম্লান হয়নি। সবই বর্তমান। যতদিন পৃথিবীতে মানুষের সঙ্কট থাকবে, মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই থাকবে ততদিন গণসঙ্গীত থাকবে। গত কয়েক বছরে পরিষদ যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে তার বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেন একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতির দায়িত্বে থাকা গোলাম কুদ্দুছ। সন্ধ্যায় ছিল গণসঙ্গীতের পরিবেশনা। প্রথমে মঞ্চে আসে মুন্সীগঞ্জের দল ‘অন্বেষণ বিক্রম’। পর পর পাঁচটি গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তারা। পরে নোয়াখালী, চাঁদপুর, শেরপুর, রাজশাহীর দলগুলো গণসঙ্গীত পরিবেশন করে ঢাকার শ্রোতাদের সমীহ আদায় করে নেন। ঢাকার দলগুলোর মধ্যে এদিন গণসঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ, ক্রান্তি, পঞ্চভাস্বর ও সুরসাগর ললিতকলা একাডেমি। অনুষ্ঠানে ছিল আবৃত্তিও। কবিতায় গণমানুষের কথা বলেন রফিকুল ইসলাম ও ঝর্ণা সরকার। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন ও নৃত্যলোক। আজ শনিবার ও আগামীকাল রবিবার পর্যন্ত চলবে গণসঙ্গীতের সমৃদ্ধ এই আয়োজন।
×