ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইসিস খিলাফতের উত্থান ও পতন

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৬ এপ্রিল ২০১৯

 আইসিস খিলাফতের উত্থান ও পতন

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) ২০১৬ সালের শেষ দিকে কুর্দী ও ইরাকী বাহিনী মসুলের ওপর আক্রমণাভিযান শুরু করে। সে অভিযান সফল হয় তবে তার জন্য মসুল নগরী ও এর অধিবাসীদের বিশাল মূল্য দিতে হয়। উগ্রপন্থীদের নগরী থেকে বিতাড়িত করে পশ্চিম ইরানকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি বছর শহরে শহরে লড়াই চলে এবং এর মধ্য দিয়ে আইসিস বাহিনীকে বহুলাংশে সীমান্তের ওপারে তাদের দ্বিতীয় ও শেষ শক্তি কেন্দ্র রাকার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। রাকা দখলের অভিযান শুরু হয় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এবং ছ’মাসব্যাপী রক্তক্ষয় ও ধ্বংসযজ্ঞের পর তার অবসান হয়। নগরী ধূলিসাত হয়ে যায়। কুর্দী বাহিনীর সঙ্গে এক সমঝোতার পর আইসিসের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। রাকা থেকে আইসিস সদস্যরা পরিবার পরিজন নিয়ে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের শেষ ঘাঁটিতে সরে যায়। তবে কুর্দী বাহিনী তাদের পশ্চাদপসারণ করতে থাকে। অবশেষে মাসব্যাপী লড়াইয়ের পর এ বছরের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শেষ ঘাঁটিটির পতন ঘটে। প্রায় ১৫ হাজার জিহাদী ও তাদের পরিবার পরিজনের একটি কাফেলাকে সমস্ত পশ্চাদপসারণে ঠেলে দেয়া হয়। এদের মধ্যে খিলাফত ভূ-খন্ডের ভেতর জন্ম নেয়া শিশুরাও আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জিহাদীদের সঙ্গে স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে হওয়ার পর এসব পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। বিদেশী মহিলারাও আইসিস সদস্যদের ঔরসজাত সন্তান জন্ম দিয়েছিল। একটি উদ্বাস্তু শিবিরের মধ্যে মার্কিন জিহাদী হোদা মুথানার কোলে দেড় বছরের এক পুত্র সন্তান দেখা গেছে। তার বাবা তিউনিসীয় যোদ্ধা। রাষ্ট্রহীন, এই ধরনের বেশ কয়েকশ’ শিশু শিবিরে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন মানুষদের মধ্যে এরা অন্যতম। বাগুজ ঘাঁটি থেকে যারা বেরিয়ে যেতে পেরেছে তারা ভাগ্যবান। আরও শত শত থেকে গিয়েছিল শহরের নিচে নির্মিত সুড়ঙ্গের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মধ্যে। আইসিসের পশ্চাদভাগ রক্ষাকারী যোদ্ধাদের মধ্যে ছিল আইসিসের সবচেয়ে ধর্মান্ধ অনুগতরা। এদের মধ্যে ব্রিটিশ ছাড়াও অন্য বিদেশীরাও ছিল। এরা ইরাকী, সিরীয়, রুশ ও তিউনিসীয়দের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। বাগদাদীর স্বপ্নের ইউটোপিয়া তাদের চারদিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মধ্যেও তারা থেকে গিয়েছিল। বাগুজের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে যাওয়া শেষ গ্রুপটির মধ্যে মার্কিন নাগরিক ফ্লোরিডার বশিরুল শিকদারের দুই সন্তানও ছিল। ওখান থেকে চলে যেতে রাজি না হওয়া ব্রিটিশ জিহাদীরা তাদের ধরে রেখেছিল। ওদের মা গত জানুয়ারিতে বিমান হামলায় আগুনে ঝলসে মারা যায়। চার বছর আগে ওদের মা খিলাফতে যোগ দেয়ার জন্য তার স্বামীকে ছেড়ে চলে আসে। ওদের বাবা সেই আমেরিকা থেকে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে চলে এসে এখন সন্তানদের সঙ্গে পুনর্নির্মিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। নতুন লড়াইয়ের আশঙ্কা : আইসিস এক সময় ইরাক ও সিরিয়ার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল তিন মহাদেশ জয় করা। সেই ইসলামিক রাষ্ট্র এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এর বিদেশী সেনা দল। দেশী যোদ্ধাদের অনেকেই নিহত বা কারারুদ্ধ এবং বাদবাকি যেসব নেতা আছেন তারা আবারও পলাতক। সহসা এমন অপ্রত্যাশিত পতন কেন হলো সেই কারণ নির্ণয়ে নেতৃবৃন্দ নতুন করে মাথা ঘামাচ্ছেন। এই বিপর্যয়কর পতনের, যেসব কারণ তারা নির্ণয় করেছেন তার মধ্যে প্রধানতম কারণটি তারা মনে করেন যে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চলছে। আইসিস অবশ্য তার খিলাফত হারানোর ব্যাখ্যা অন্যভাবে দিয়েছে। বলেছে যে এটা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ সম্ভবত খিলাফতকে তারা ভুলত্রুটির জন্য শাস্তি দিচ্ছেন কিংবা কঠোর দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ আরোপ করে খিলাফতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তবে কারণ যাই হোক, সমর্থকদের উদ্দেশে খিলাফতের বক্তব্য হচ্ছে এর উপযুক্ত জবাব হলো দ্বিগুণ উদ্যম ও নিষ্ঠার সঙ্গে জিহাদী কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়া কারণ আল্লাহ এমনটাই চান।’ বাগুজের পতনের দিনগুলোতে আত্মসমর্পণকারীদের কেউ কেউ নতুন বার্তাও নিয়ে এসেছে। যেমন আটক কেন্দ্র নিয়ে যাওয়ার সময় নিকাবপরা দুই মহিলাকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ইসলামিক রাষ্ট্র আবার জেগে উঠবে। এদিকে আইসিসের প্রধান নেতা বাগদাদীকে ধরার জন্য যে বিশাল জাল বিস্তার করা হয়েছিল তিনি ফাঁক গলিয়ে সরে পড়েছেন। তার অতি ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে শোনা যায়, তাঁর সবচেয়ে অন্ধ সমর্থকরাই একদিন তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন আশঙ্কা তার বরাবরই ছিল। গত ৫ বছর ধরে যারা হন্যে হয়ে বাগদাদীর সন্ধান করে বেড়াচ্ছিলেন তাদের মতে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপদ নিয়ে বাপদাদীর এক ধরনের আচ্ছন্নতা ছিল এবং তা সঙ্গত কারণেই ছিল। সে জন্যই তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে যাওয়া কাউকেই ধারে কাছে মোবাইল ফোন বহন করতে দেয়া হতো না। পাছে তা ড্রোনের স্পর্শকাতর যন্ত্রে ধরা পড়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে যে, বাগদাদী সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে তাঁর চির পরিচিত এলাকা ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলে চলে গেছেন। এক কুর্দী নেতা বলেন, আইসিসের হাত থেকে ভূখন্ড পুনরুদ্ধার এ যুদ্ধের মুখ্য বিষয় ছিল। এর জন্য অবশ্য চড়া মাশুল দিতে হয়েছে। তবে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল তল্লাটজুড়ে অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট আগের মতোই অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়ে গেছে। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সঙ্কট ও অভাব অভিযোগের প্রতিকার না হলে আইসিস আবার নতুন রূপে আবির্ভূত হবার সমূহ আশঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে ফোরাত নদীর দুই তীর ছোটখাটো সেসব লক্ষণ ফুটে উঠছে তাতে গেরিলা যুদ্ধের ভূত উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। আইসিস ইতোমধ্যে তার ভূ-খন্ড গত পরাজয়ের সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে গেছে। তারা সেই সব এলাকায় আবার নতুন উদ্যমে কোমড় বাঁধছে সেখানে আগে থেকেই বিরাজমান সাম্প্রদায়িক ফল্ট লাইনগুলো এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা অবলম্বন করছে নতুন কৌশল। তাদের সন্ত্রাস থেকে মুক্ত এলাকাগুলোতে। আইসিস সেলগুলো ইতোমধ্যে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। (সমাপ্ত)
×