ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ মন ও মানুষ

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ৫ এপ্রিল ২০১৯

বই ॥ মন ও মানুষ

মন ও মানুষ গল্প সঙ্কলনটি লিখেছেন হাসান মাশরিকী ও কানিজ শিরীন। ২০১৯ সালের একুশে বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। প্রকাশক ইতি, প্রচ্ছদ আঁকেন অরূপ মান্দি। বইটি উৎসর্গ করা হয় লেখকদ্বয়ের মা-বাবাকে। হাসান মাশরিকীর গল্প ‘নিরুদ্দেশ’ দিয়ে শুরু করা হয় গ্রন্থটি। বিষয়বস্তু মূলত এক উদীয়মান তরুণীর কষ্ট, বেদনা আর অনুভবের এক বিচিত্র ঘটনা পরম্পরার অবিমিশ্র কথামালা। মায়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা চিঠিতে মার সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন এক স্নেহকাতর কন্যার হৃদয় উপচেপড়া আবেগ পাঠককে সত্যিই বিচলিত করে। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে যে পারিবারিক বেষ্টনী তার আনন্দঘন প্রতিবেশ যে মাত্রায় সবার জীবন পূর্ণ করে দেয় তার বিপরীত অবস্থা কতখানি দুঃখজনক গল্পটির মূল সারবত্তায় তারই করুণ অনুরণন ঝঙ্কৃত হয়। মায়া-মমতায় মাতৃত্বের যে চিরায়ত শৌর্য সেটাই কোন নারীকে তার মহিমান্বিত রূপে অলঙ্কৃত করে। সেই নারী যখন একজন মানুষের দাবিতে নিজের অধিকার ও স্বাধীনতায় গড়ে উঠতে চায় সেখানে বাস্তব জীবনের কষাঘাত কোন পর্যায়ে সন্তানদের জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে তারই একটি সচিত্র প্রতিবেদন এই নিরুদ্দেশ গল্পটি। চিঠিতে মেয়ের অভিযোগের কোন অন্ত নেই। মা কিভাবে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেতে ঘরকন্নাকে রীতিমতো দূরে সরিয়ে দেয় সেটাই কাহিনীর মূল অবয়বে প্রভাবিত হয়। মেয়ে নিজেও বোঝে মেয়েরা শুধু সংসার সামলাতে জন্ম নেয়নি। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সব ধরনের অধিকার অর্জনের প্রত্যয় থাকা যে কোন মানুষের আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন। আর সেই প্রত্যাশিত স্বপ্ন লালন করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে মেয়েদের অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়। কিন্তু সমাজ সংস্কারের গতানুগতিক বেড়াজালে নারীদের সেই কঠিন পথপরিক্রমা কখনও সহজ আর স্বাভাবিক থাকে না। কিন্তু সন্তানরা বাবার প্রতিষ্ঠাকে সম্মান জানালেও মায়ের আকাক্সিক্ষত স্বপ্নকে সেভাবে মেনে নিতে পারে না। এই এক সামাজিক ব্যাধি যাকে অতিক্রম করা সহজসাধ্য হয় না। সন্তানের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কষ্টকর অনুভূতি মাকে বিষাদ আর অবসন্নতায় নিথর করে দেয় সেই যন্ত্রণাও গল্পটির অন্য আর একটি বার্তা। কানিজ শিরীন লিখেছেন চারটি গল্প। ‘স্বপ্নের সেই জন’ গল্পটি মূলত ত্রিভুজ প্রেমের আদলে লেখা হলেও কোন এক সময় সেই মোহাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতেও কাউকে বেগ পেতে হয়নি। কাহিনীর গতি নির্ণয়ে শাহেদ, মৌরি ও রূপমের আবেগ-অনুভূতির যে শৈল্পিক সুষমা পাঠককে অভিভূত করে সেখানে লেখকের নান্দনিক মহিমা ও নানামাত্রিকে পরিস্ফুট হয়। ভালবাসার নির্মোহ চেতনায় নিবেদিত গল্পের চরিত্রগুলো বিষয়বস্তুর মূল বার্তাকে পাঠকের সামনে হাজির করে। কাহিনী গন্তব্যে এগিয়ে যাওয়ার কোন এক মুহূর্তে শাহেদ চলে যায় আমেরিকায়। পরবর্তীতে চিঠিতে জানিয়ে দেয় রূপমকে মৌরির সঙ্গে তার ক্ষণিকের আবেগ জেগে উঠলেও সে এখন অন্য কিছু ভাবছে। এখন মৌরির সঙ্গে তার কোন যোগাযোগও নেই। এরপর রূপম আর মৌরির সম্পর্কের কোন টানাপোড়েন না থাকলেও বিয়ে করার কথা চিন্তাও করে না দু’জনই। মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়ে রূপম বিস্মিত হয় নববধূ আর কেউ নয় স্বয়ং মৌরি। এভাবে এই ত্রিভুজ সম্পর্কের আখ্যান তার গন্তব্যে গিয়ে থামে। ‘দহন’ গল্পটি ভালবাসার মহিমায় নিবেদিত নায়কের আত্মদহনের কাহিনী। মাসুদ শিক্ষার্থী জীবনে তারই জুনিয়র লোপাকে ভালবাসে মনপ্রাণ উজাড় করে দেয়। কিন্তু পরিণতি সুখকর হয়নি। লোপার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় আর মাসুদ জীবনে ‘বিয়ে’ নামক ব্যাপারটিকে সযতেœ সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে। তার পরেও জীবন কখনও থেমে থাকে না। নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সময়ের মিছিলে শুধু এগিয়ে চলে। ভিন্ন জায়গায় অন্যরকম পরিবেশে মাসুদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কেটে যায়। আর লোপার বিবাহিত জীবন ও চরম এক হতাশা এবং গ্লানিতে ভরে উঠলেও পেছনের দিকে তাকানোর অবকাশ ছিল না। অনেক পরে এক চিঠিতে লোপা মাসুদকে তার ঘটে যাওয়া জীবনের করুণ কাহিনী শোনায়। এভাবে অন্য গল্পগুলোও প্রতিদিনের যাপিত জীবনের হাসি, কান্না, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভরসা আর চিরায়ত প্রেমকে আবর্ত করে গড়ে ওঠে। সহজ, সাধারণ গল্পগুলোর শৈল্পিক বোধ পাঠককে মুগ্ধ করবে। বইটির বহুল প্রচার আশা করছি।
×