ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওনলি ফর এ্যাডালটস

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ৫ এপ্রিল ২০১৯

ওনলি ফর এ্যাডালটস

মোতালেব সাবের মুখের মাঝে একটা চোর চোর ভাব, পানসে হয়ে আছে সারা মুখ। কোন কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। হাঁটার দলের সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। একটু উদ্বেগের সঙ্গে একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হলো ভাই, আপনার, মুখে টেপ মেরে আছেন কেন? কথার কোন জবাব নাই। একটু চাপাচাপির পর যা জানা গেল তাতে সবাই হাসবে না দুঃখ প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, মোতালেব ভাই ধরা পড়ে গেছেন, একেবারে হাতেনাতে। অপমান, লজ্জা সব মিলিয়ে একেবারে জবুথবু অবস্থা। মোতালেব সাব রোজ ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় এসে দুটো বিস্কুট দিয়ে চিনি ছাড়া এক কাপ লাল চা খেয়ে পোশাক চেঞ্জ করে হাঁটতে বের হন। হঠাৎ তাঁর নজর পড়ল ফ্রিজের দিকে। ফ্রিজে তো মিষ্টি জাম মারা। গতরাতে তাঁর ভায়রা শ্যালিকাকে নিয়ে এসেছেন। হাতে করে সন্দেশ, রসমালাই ইত্যাদি প্যাকেট ভর্তি করে নিয়ে এসেছে। ড্রইংরুমে জমজমাট আড্ডা। শ্যালিকার আনা মিষ্টির সঙ্গে বাসায় তৈরি কিছু আইটেমও যোগ হয়েছে। প্লেট গ্লাসে টেবিল ভর্তি। সবাই যখন মনের সুখে খাওয়া দাওয়া, হাসি ঠাট্টায় মশগুল, তিনি লুব্ধ নয়নে একদিকে রসমালাই খাওয়া আর অন্যদিকে গিন্নির রক্ত চক্ষু অবলোকন করছেন। এই লাল চোখের অর্থ হচ্ছে, সাবধান, একটা মিষ্টি খাও তো খবর আছে। মনে মনে ভাবছেন, খাওয়া দাওয়া ছাড়া তিনি শুকনো মুখে আসরে যোগ দিতে পারছেন না। ভাল খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে এমনিতে রং বেরঙের কথা ফুটে, মাঝে মাঝে একটা তৃপ্তির ঢেকুর উঠে। তাঁর দুঃখ হয়, এই রোগী মানুষটার কথা কেউ ভাবে না। বেটা হাতে করে প্যাকেট ভর্তি করে নিয়ে আসবে, তাও শুধু মিষ্টি। বাজারে কি মিষ্টি ছাড়া আর কিছু নেই। তোর দুলাভাইয়ের যে ডায়বেটিস এটা খেয়াল করবি না। কাটলেট, কেএফসি, সিএফসি কত হরেক রকমের খাবার আছে। শিউলিটা যে কি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, আগে দুলাভাই বলতে অজ্ঞান, বিয়ের আগে বছরের আধা দিন সেজ আপার বাসায় পড়ে থাকত। তখন এই দুলাভাই ছাড়া কিছু চলে না। দুলাভাই, আজ শিল্পকলায় নাগরিকের ভাল নাটক আছে, নূর, আলী জাকের এরা থাকবে, কাছে থেকে দেখা যাবে। ফেরার পথে টিকেট নিয়ে আসবেন। এ রকম যত সখ, আহ্লাদ সব এই দুলাভাই। মোতালেবও এই শ্যালিকার আবদার ফেলতে পারতেন না, নিজের ছোট বোনের মতো দেখতেন। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুলাভাইয়ের প্রতি টানেও ভাটা পড়েছে; আর বিয়ের পর তো আর কাছেই ঘেঁষে না। অসুখ হওয়ার পর তাঁর খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সেও আপার সঙ্গে তাল দেয়। মোতালেব সা’বের পুরনো ডায়বেটিস। তিনি নিজেই বলেন, ‘কি যে করি ভাই, ইনসুলিন বাড়িয়েও কমানো যাচ্ছে না। এর মাঝে তিনি চান্স পেলেই মিষ্টি খান। এখন প্রাত ভ্রমণের জন্য রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় তাঁর মাথায় চকিতে একটা বুদ্ধি খেলল, বাসার লোকজনত উঠতে এখনও অনেক বাকি। তিনি ছাড়া এখন আর কেউ জেগে নেই, এই সুযোগে, মনের সাধে কিছু মিষ্টি খেয়ে নেয়া যায়। কথাটা মাথায় আসা মাত্রই সময় নষ্ট না করে তিনি ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খাওয়া শুরু করলেন। অল্প সময়ে যত বেশি উদর পুর্তি করা যায়। মিষ্টির বাক্স আর ফ্রিজ থেকে বের করেননি, তর সইছে না, আর যত কম সময়ে কাজ শেষ করা যায়। প্রথম প্যাকেট খুলেই দেখেন রসমালাই। রসের মাঝে ডুবান মালাই, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। তালে বেতালে মুখে পুরতে গিয়ে মুখের বাইরেও রসে লেপটে আছে; খাচ্ছেন আর ভাবছেন আহা! কি স্বাদ, যেন জীবনে খাননি। হঠাৎ চোর, চোর শব্দে ছোট নাতির চিৎকার শুনে তিনি একেবারে ভ্যাবাচেকা! ও মনে হয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠছিল। পথে এ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করছে। এক নিমিষে মেহমানরাসহ সারা বাসার মানুষ হাজির। সি ই ও গিন্নি তো হতভম্ব, রাগে অগ্নিসর্মা। কি বলবে কথার খেই হারিয়ে ফেলছে। প্রথম বান, বুড়ো, ভ্যামড়া, যত বুড়ো হচ্ছে, জিহ্বা তত লম্বা হচ্ছে, নিজের দোষে শরীরটাকে ব্যারামের ফ্যাক্টরি বানিয়ে রাখছে, এখনও খাওয়া দেখলে জিহ্বা লক লক করে। এক পা কবরে, এখনও লোভ সামলাতে পারে না, মাথায় গোবরে ভরা, কাণ্ডজ্ঞান সব হারিয়ে ফেলছে। শ্যালিকা একটু পিন মারল, আপা, মুখটা বন্ধ করলে হয় না, দুলাভাইয়ের মনে চাইছে, একটু খেয়েছে, কি হয়েছে এতে, এক দিনই তো। এতে আপা আর ক্ষেপে উঠল, তুই যা জানিস না, তাতে কথা বলতে আসবি না, একদিন, তুই জানিস, চান্স পেলেই ও মিষ্টি খায়, মিষ্টি দেখলে ওর বুদ্ধি জ্ঞান সব লোপ পায়। মোতালেব সা’বের অবস্থা ফার্মগেটে পকেট মার ধরা খেলে এক দফা গণধোলাইয়ের পর তারই ওস্তাদরা মাতবর সেজে এসে তাকে বিচারের উছিলায় মুক্ত করার পর মুখের যে ভাব হয় সে রকম। লজ্জায়, অপমানে, বিশেষ করে মেহমানদের সামনে তিনি যে এ রকম একটা অবস্থায় পড়বেন ভাবলে কান্না আসে, কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না। মনে হলো কোন রকম তাকে নিয়ে গড়া এ জটলা থেকে বের হয়ে আসতে পারলে বাঁচেন। কিন্তু বের হলেও জবুথবু ভাব কাটছে না। আমরা তাঁর হাঁটার সঙ্গীরা ঘটনা শুনে তাঁকে সান্ত¡না দেব, না তিরস্কার করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে হাসিও পাচ্ছিল। তাঁর নিজের অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আমাদেরও প্রায়ই তাঁর ডায়বেটিসের আপডেট দেন। এরপরও সকালে যে গোল বাঁধিয়েছেন এটা বালখিল্য ছাড়া আর কিছু নয়, নিরেট মূর্খতা, কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের মতো কাজ। একদিকে যেমন রাগ হচ্ছিল তাঁর এই বেকুবের মতো ঘটে যাওয়া কাহিনী শুনে, অন্যদিকে আমরা একটা শেষ মিশ্রিত কৌতুকও বোধ করছিলাম। যারা নিজেদের একটু উচিত বক্তা মনে করেন তারা ডাইরেক্ট তাকে আক্রমণ করে কথা বলছিলেন। আপনার কি হুস বুদ্ধি জীবনে হবে না? বাসাভর্তি মেহমান, খাওয়ার যখন এত খায়েস হয়েছিল তখন বাসাটা একটু ঠাণ্ডা হলে ধীরে-সুস্থে খান না, উচিত শিক্ষা হয়েছে, মকবুল সাব গলার স্বর একটু উঁচু করে বললেন। সাধে কি আর বলে, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট; আপনার ক্ষেত্রে হাতে হাতে তো ফল পেলেন। মোতালেব সাব আর কি বলবেন, একেবারে কুচকে আছেন। ইকবাল সাব একটু রস করে বললেন, ভাই, একা না খেয়ে প্যাকেটশুদ্ধ এখানে চলে আসলে হতো, তাহলে আপনারও এ দশা হতো না, আমরাও আপনার রসের ভাগিদার হতাম। প্যাকেট খোয়া গেলে আপনাকে কেউ সরাসরি আসামি বানাতে পারত না। হাব ভাব দেখে এই নানা কিসিমের কথা উনি শুনছেন কি না বোঝা যায় না। তবুও সঙ্গী হিসেবে ভদ্রতার খাতিরে একটা কিছু বলতে হয়। আমাদের মাঝে ঠাণ্ডা মাথার দু’চারজন বেচারার সার্বিক অবস্থা চিন্তা করে একটু সান্ত¡নার স্বরে বলল, যা ঘটছে তা তো আর শোধরান যাবে না, ঘটনাটি আপনার জন্য শাপে বর হয়েছে। আজ যে শিক্ষা হলো এরপর আর এ রকম মনে হয় আর হবে না। সবই তো আপনার ভালর জন্য। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আকর্ষণটা একটু তীব্র হয় । সে হিসেবে ডায়বেটিস ওয়ালাদের মিষ্টির লোভটা বেশি থাকে। কোন থিউরিই কাজ করে না এ লোভ সামলাতে। স্কুল জীবনে সিনেমা হলে যে ইংলিশ ছবির বড় পর্দায় লেখা থাকত,’ড়হষু ভড়ৎ ধফঁষঃং’সে ছবি লুকিয়ে দেখার ঝোঁক থাকত তত বেশি।
×