ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাগর জামান

মিনার মাহমুদ ॥ স্মৃতির ভুবনে অবিরাম বিচরণ

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ৫ এপ্রিল ২০১৯

মিনার মাহমুদ ॥ স্মৃতির ভুবনে অবিরাম বিচরণ

কোন দ্বিধা নেই, কোন সংশয় নেই, কোন কুণ্ঠা নেই , আমার লেখক চেতনার গুরু আর কেউ নয়, একজনই, সে হলো মিনার মাহমুদ। আমার প্রিয় মিনার ভাই। যাকে আমি সম্পূর্ণ ধারণ করেছি। আমার অসম্পন্নতা দূর করতে চেয়েছি। যার শক্তিময় দ্যুতিমান লেখক সত্তা আমাকে বিশুদ্ধ প্রিয়তায় বিমুগ্ধ করেছে। বেঁধে ফেলেছে। আমি গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে, সবটুকু ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে পাঠ করেছি তার অনবদ্য গল্প গ্রন্থ ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ কিংবা সাপ্তাহিক বিচিন্তার তার স্বনামের অথবা ছদ্মনামের বিভিন্ন আবেগপ্রবণ স্পর্শকাতর প্রবন্ধ আর প্রতিবেদন। চির ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে মিনার মাহমুদ নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে নামের আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি মুদ্রণ মাধ্যমকে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মনে করতেন। তিনি বলতেন ‘মিডিয়া হিসাবে টেলিভিশনের এখন ভীষণ বাজার। কিন্তু স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে খুবই তাৎক্ষণিক। অনেকটা বিদ্যুতের মতো। আচমকা চারদিক আলোকিত করে মুহূর্তে হারিয়ে যায়, সময়ের গর্ভে। কিন্তু মুদ্রণ মাধ্যম স্থায়ী। অক্ষরে আর কাগজে থেকে যায় এই অবিনাশী আয়োজন, পরবর্তী হাজার বছর। আর তাই, সভ্যতায় সাংবাদিকতার মূলধারা আজও আদি মুদ্রণ-মাধ্যম।’ ছাত্র জীবন থেকে মিনার মাহমুদ লেখালেখি শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। ৮৭তে তিনি বিচিন্তা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। অকপটে সামরিক শাসন বিরোধী বক্তব্য প্রকাশের জন্য তাকে ৮৮তে গ্রেফতার করা হয়। সামরিক শাসক পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। ৯১ এ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় এলে তিনি পুনরায় সাপ্তাহিক বিচিন্তা প্রকাশ করেন। কিন্তু কিছু দিন পর পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এরপর দীর্ঘকাল আর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেননি। ২০০৯-এ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাজ করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া বিচিন্তা পুনর্প্রকাশ করেন। এ বছরের শুরুতে তিনি শান্তা মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বলা হয়েছে বাংলাদেশে সাপ্তাহিক রাজনৈতিক পত্রিকায় রিপোর্টিংভিত্তিক বিদ্রোহী ধারার আধুনিকতার প্রবর্তক ছিলেন মিনার মাহমুদ। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে তিনি আজকের প্রত্যাশা নামক একটি দৈনিক পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সাপ্তাহিক বিচিন্তা সম্পাদনার সময়টা ছিল মিনার ভাইয়ের বিরুদ্ধ ¯্রােতে যাত্রার সময়। সাপ্তাহিক বিচিন্তার মাধ্যমে মিনার মাহমুদ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে একটি নবতর ধারা সংযোজন করেছিলেন সফল ভাবে। অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করতে হয়েছে। একের পর এক মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। মিনার ভাইকে। তিনি ‘পেছনে ফেলে আসি’ শিরোনাম দিয়ে নানা অভিজ্ঞতার ইতিবৃত্ত তুলে ধরতেন। তাকে কারাবাস করতে হয়েছে। এদেশে সত্য কথা বলার অপরাধ অনেক। মিনার মাহমুদ সে অপরাধের দায় বয়ে বেরিয়েছেন। এভাবে সত্যের জয়ের জন্য লড়াই করেছেন। নিউজ প্রিন্টের খসখসে শরীরে ভ- রাজনীতিকদের অসততার কথা সমাজের নানা অসঙ্গতি, অবক্ষয়, স্বদেশের গৌরবগাথা তুলে ধরেছেন। তার যাত্রাপথে তরুণদের তিনি শামিল করেছিলেন। তরুণদের কষ্টে তিনি পীড়িত হতেন। বিচিন্তায় তিনি তারুণ্যের কষ্টের কথা তুলে ধরতেন। ‘পড়াইতে চাই কাঁদিতেছে তরুণ’ এ ধরনের শিরোনামের লেখা স্থান পেত বিচিন্তার কাগজে। বিচিন্তা থেকে একবার জাদু শিল্পী জুয়েল আইচকে বলা হয়েছিল আপনি কি এমন জাদু জানেন যে জাদু দিয়ে তারুণ্যের সব কষ্টকে নিমেষে শেষ করে দেয়া যায়, দিতে পারবেন? তারুণ্যের শক্তিকে মিনার মাহমুদ ভালবাসতেন। একঝাক বিশ পেরুনো তরুণকে তিনি বিচিন্তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন তিনি। অনুজ সাংবাদিকদের তিনি মাসিক বেতন নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট অঙ্কে দিতেন না। পকেটে হাত দিয়ে যা উঠত তাই সই। তাই দিতেন। তিনি বলতেন ‘এভাবে ছাড়া অন্যভাবে দিলে টাকা পাবে, মিনার ভাই পাবে না।’ বিচিন্তা পরিবারকে তিনি অভিন্ন আনন্দ বেদনার অংশীদার করেছিলেন। প্রীতির ছত্রতলে থেকেছেন অনুজ সাংবাদিকদের নিয়ে। বিচিন্তা দিয়ে মিনার মাহমুদ পাঠকদের আবেগ ভালবাসায় আবদ্ধ করেছিলেন। সাহিত্যের আবেদনে একটি ঘটনাকে উপস্থাপনের নিপুণ কৌশল মিনার মাহমুদ বিচিন্তায় প্রয়োগ করেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তিনি মনেপ্রাণে একজন পরিণত সাহিত্যের মানুষ ছিলেন বলেই। তিনি ছিলেন প্রচ- অনুভূতি প্রবণ সংবেদনশীল একজন মেধাবী সাংবাদিক। সাহিত্যের বরপুত্র। সে কারণে তার পত্রিকার পাতা অসহায় মানুষের করুণ কাহিনীতে ভরে যেত। মানুষের অসহায়ত্ব বেদনা বিহ্বলতা সাপ্তাহিক বিচিন্তা সহমর্মীর মতো ধারণ করত। চাকরি না পাওয়া বেকার তরুণের আর্তনাদ, নষ্ট পল্লীর কিশোরী মেয়ের যন্ত্রণা যাপিত জীবনের বর্ণনা অথবা রক্ত বিক্রির বেসাতি করে যে লোকটা। বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধরত মানুষদের কথকতা উঠে আসত তার লেখায়, বিচিন্তার পাতায়। এসব করুণ কাহিনী বিচিন্তায় প্রকাশিত হতো গুরুত্বের সঙ্গে। মিনার মাহমুদ ছিলেন প্রচ- পরিশ্রমী, নির্ভীক, লড়াকু ও উদার সাংবাদিক এবং একজন পরিপূর্ণ স্বপ্নবান মানুষ। যেসব তরুণেরা তুমুল সম্ভাবনাময় হওয়ার সত্ত্বেও অন্যান্য পত্রিকায় জায়গা পেতো না, মিনার মাহমুদ তাদের জায়গা দিয়েছেন। নিজ হাতে কাজ শিখিয়েছেন। মিনার মাহমুদ অনেক বড় মনের এবং অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। অনুজ প্রতিম সহকর্মীদের সঙ্গে ছিল তার গভীর হৃদ্যতা। তুমুল বন্ধুত্ব। মিনার মাহমুদ তার লেখক জীবনে কখনো অন্যায়ের কাছে অবনত হননি। বরং তার সততা আর সত্যবদ্ধ সাংবাদিকতায় অসৎ মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। অসৎ মানুষেরা মিনার মাহমুদের দুর্বার প্রকাশনায় আতঙ্কিত হয়েছে। মিনার ভাই তার সত্য নিষ্ঠ সাংবাদিকতা দিয়ে প্রতিপক্ষকে প্রতিঘাত করেছেন। হত্যার হুমকি শারীরিক উৎপীড়নের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে চোখ রাঙানোকে গণ্য না করে তার উচ্চারণকে উচ্চকিত রেখেছেন। তিনি কখনো পিছু হটেননি। বরং বিচিন্তাকে আরো লাগাম ছাড়া আরো দুরন্ত করেছেন। আরো নির্ভীক হয়েছেন। মিনার মাহমুদ লেখালেখির উন্মাদনায় সব প্রতিবন্ধকতাকে মেনে নিয়েছেন। জয় করেছেন । তার কীর্তিমানতা ও তার লেখক জীবনের আদর্শ থেকে তিনি এতটুকু বিচ্যুত হননি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে সাপ্তাহিক বিচিন্তা হেঁটে গেছেন অমসৃণ কণ্টকাকীর্ণ পথে। একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে একজন সাবেক রাষ্ট্র প্রধানের নামে লেখার অপরাধে মাস্তানরা তাকে পড়াশোনা শেষ করতে দেয়নি। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিচিত্রার চাকরি হারাতে হয়। তারপর ব্যতিক্রমী ধারার সাপ্তাহিকী বিচিন্তা নিয়ে মিনার মাহমুদ যাত্রা শুরু করেন। ভালোবাসা সম্বল করে তিনি তার কর্মী বাহিনী প্রস্তুত করেন। গড়ে তোলেন বিচিন্তা পরিবার। ‘আমাকে দেখতে দাও, আমাকে বলতে দাও’ এই স্লোগানকে ধারণ করে মিনার মাহমুদ দোর্দা- প্রতাপে বিচিন্তা প্রকাশনা চালিয়ে যান। পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সামদৃত হয় এই পত্রিকাটি। শুরুতেই ঝক্কি। আতে ঘা লাগে অনেকের। মিনার ভাইকে একের পর এক মামলার শিকার হতে হয়। জেল জীবন কাটাতে হয়। মুক্ত হয়ে আবার যাত্রা, আবার প্রতিবাদে ফেটে পড়া। আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, এটা ভুল, এটা সঠিক নয়। ওরা অপরাধী, ওরা ভ-। তার পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিচিন্তা পরিবারের ওপর আবার বিপর্যয়। মিনার ভাই এক সময় দিশেহারা হয়ে পড়েন। এনায়েত উল্লাহ খানের ওপর বিচিন্তা দায়িত্ব অর্পণ করে মিনার মাহমুদ প্রবাসে বসবাসের পথ বেছে নেন। বিদেশে যাওয়ার আগে মিনার ভাই বলেছিলেন। ‘আমার এই চলে যাওয়া পলায়ন নয় প্রতিবাদের নিশ্চুপ ভাষা।’ বিচিন্তার পরিবার অযুত কণ্ঠে হুহু কেঁদে ছিল। মিনার মাহমুদ এক সময় বলেছিলেন ‘যাবো না আমি, এদেশ হায়েনার বধ্যভূমি নয়।’ তবু মিনার ভাইকে আমেরিকায় চলে যেতে হয়েছিল। মিনার মাহমুদ ছিলেন পুরোপুরি একজন সংগ্রামী মানুষ। তিনি সংসারী মানুষ হতে পারেননি। নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। আরও একজন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় প্রেম অতঃপর বিয়ে। মিনার ভাই বিদেশের দাসত্ব ছেড়ে স্বদেশের টানে ফিরে এলেন। দেশে ফিরে দেখলেন তার এক সময়কার সহচর যারা ছিলেন, যারা অনেকে মিনার মাহমুদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে অনেক। পুরনো বন্ধুদের সহযোগিতা মেলে না মিনার ভাইয়ের। তবু তিনি দমে যাননি। অদম্য উদ্যম নিয়ে তিনি বিচিন্তা পুনরায় প্রকাশ করেন। তারপর এক সময় তুমুল অভিমানে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হন। একটি দৈনিক পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। এক সময় হাঁপিয়ে ওঠেন। চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। তুমুল অভিমান প্রচ- হতাশা তাকে সম্পূর্ণ দখল করে নেয়। গ্রাস করে ফেলে মিনার মাহমুদের মনোশক্তিকে। তিনি একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষে বসে তার প্রিয়তমা নববিবাহিত স্ত্রীকে দীর্ঘ চিঠি লিখেন। নিপীড়নের কথা ব্যক্ত করেন। ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপর একের পর এক ঘুমের ওষুধ খেয়ে অন্তহীন ঘুমের মধ্যে নিহত হয়ে যান। এভাবে যবনিকা ঘটে তুমুল সম্ভাবনাময় একটি জীবনের। ঘুমের ওষুধ হয়তো মিনার ভাইকে আর কখনো জাগতে দেবে না। কিন্তু তার প্রতি আমাদের ভালবাসা নির্ঘূম থাকবে। থাকবেই। তার ভক্ত কুল থাকবে যতদিন। ততদিন আমাদের ভালবাসা, ভাল থাকবে জেগে থাকবে। মিনার ভাই তুমি শান্তিতে ঘুমাও। তোমার স্বপ্নসমূহ বুকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব।
×