ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৫ এপ্রিল ২০১৯

কিছু স্মৃতি

বান্ধবী আমিনা মাহমুদের ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে আমাদের হাসাহাসি হতো খুব। ওর র‌্যাকেটে কর্ক লাগত না প্রায়শই। যদি বা লাগত, তো সেটি নেটের এ পাশেই ঠক্্ করে ভূমিশয্যা গ্রহণ করত। তবু ওর খেলা চাই-ই। কেউ ওকে জুড়ি হিসেবে নিতে না চাইলেও সে একেবারে নাছোড়বান্দা। ফলে আমাদের খেলা মাটি! ছোট ছোট দলে মাঠে বসে গান গাওয়া-গান শোনা ছিল বিশেষ আনন্দের। মাহেরা নামের উর্দুভাষী একটি মেয়ে লতা মঙ্গেশকারের গাওয়া ‘আয়েগা আয়েগা আয়েগা আনেওয়ালে’ গাইতো নিখুঁত দক্ষতায়, অবিকল সুরে। সে আমলে আধুনিক, বাংলা বা হিন্দী সিনেমার গানে কোন আপত্তি বোধ করিনি। তখনকার বেশিরভাগ গানই বেশ মনে লাগত। মমতাজ লিলি খানের গলায় ভাল সুর ছিল না। তবু ‘ইয়ে আফসানা নহি হ্যায় দিল/মুঝে তুমসে মুহব্বত হ্যায়’ ওর কাছ থেকে লিখে গেয়েছি দিব্বি! আমি তখন তালাত মাহমুদের গাওয়া গান রেডিও থেকে তুলে খুব গাইতাম। Ñ‘হয়তো সেকথা তোমার স্মরণে নাই। /আমার জীবনে পরম লগন সে যে/ভুলিতে পারি না তাই’, ‘ফুল দিতে যদি ভুল হয়ে যায়,/যেন ভুলো না গো মোরে’ ...। তাঁর একটা গীত বাজত রেডিওতে- তাসবীর তেরি দিল মেরা ব্যহলীনা সকেগি’। তালাত মাহমুদের মৃদু আর রোমান্টিক কণ্ঠের আকর্ষণ ছিল দুর্বার। ‘দুটি পাখি দুটি তীরে/মাঝে নদী বহে ধীরে’- ও তো তাঁরই গাওয়া গান। রেডিও আমাদের গান তুলবার বড় অবলম্বন ছিল তখন। তালাত মাহমুদের ভারি চমৎকার একটি গজল খুব ভাল লাগত শুনতে। প্রথম লাইনের সুরটা আবছা আবছা মনে আসলেও কথাগুলো কিছুতেই মনে আসছে না। কলেজের বাইরে বান্ধবী নূরুন্নাহার আবেদিনের বাড়ি গিয়েও কত যে গান গেয়েছি। আমার দু’বছরের বড় বোন রীনা উৎপলা সেনের গান ভাল গাইত, কাজগুলো সুন্দর উঠত ওর গলায়। ওর আড়ালে আমিও উৎপলার গান গাইতাম। -‘যেতে হবে, তোরে যেতে হবে/এই তিমির রজনী পার হয়ে’। শুনেছিলাম, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ উপন্যাস অবলম্বনে করা সিনেমায় ছিল গানটি। নুরু আর ওর মাইজ্যাদা (আমাদের ‘দাদা’)-র প্রিয় গান এটি। উৎপলা সেনের ‘যদি ভুল ভেঙ্গে যায় কোনদিন’, ‘তুমি যে ভালবেসেছিলে, সে যেন রূপকথা’, ‘পরদেশী পথিক প্রিয়, বনফুল জাগে পথের ধারে’, আরও কত! উৎপলা সেন যে একখানি হিন্দী গানও গেয়েছিলেন, সে এখনকার মানুষ জানে কি?Ñ‘কিউ আসকো ইউ বে-আসা কিয়া/কিউ প্রীতকা বন্ধন তোড়া’। দাদারা এ গানের দারুণ ভক্ত ছিলেন। আমিও গাইতাম বিভোর হয়ে। নূরুদের ওখানে আনসারী ভাই বলে একজন আসতেন মাঝে মাঝে। সুন্দর গলা ছিল। গাইতেন কী এক হিন্দ্রী-সিনেমার গান-‘মেরা সুন্দর স্বপ্না জিত গ্যয়া’। ম্যয় প্রেমসে সব কুছ হায় গয়ি,/ বি-দরদা জামানা জিত গ্যয়া। প্রেমিক-প্রেমিক বিরহী-বিরহী ভাব ছিল আনসারী ভাইয়ের। সেই ভাব ধরে গান গাইতেন। সে বয়সে আমাদের কাছে ওসব দারুণ লাগত। মনে হচ্ছে, ‘তাসবীর তেরি দিল মেরা ব্যহলা না সকেগি’ গানটাও ওরই মুখে শুনতাম। নূরু-দাদারা আমার কাছে সুপ্রভা সরকার আর কানন দেবীর গান শুনতে একটুও ক্লান্ত হতো না। ওঁদের ছোট বোন কমু তখন চট্টগ্রামে লেখাপড়া করত। ঢাকায় এলে ও-ও মুগ্ধ শ্রোতার দলে যুক্ত হয়ে যেত। সুপ্রভার ‘এ পথে যখনি যাব বারেক দাঁড়ায়ো ফুলবনে। শুধু দু’হাত ভরিয়া দেব ফুল’ গাইতাম প্রায়ই। এখন বয়স আর অসুস্থতার দরুন আমার গলাটা কেমন বুজে গেছে, গাইতে পারি না আর। তবু ওদের পরিবারের সকলেই এখনও ওই গান শুনতে চায়। নূরুর খালাত বোন আমার বন্ধু মাক্কী (ডাকনাম ‘মাখন’ থেকে চাটগাঁওয়ের ভাষায় আদরে ওই সংক্ষেপ রূপ) ‘এ পথে যখনি যাবে’ গানের জন্যে একেবারে পাগল ছিল। গান শুনত, যেন সর্বাঙ্গ দিয়ে! ওর মৃত্যুপরবর্তী ঘরোয়া সমাবেশে, পুরানা পল্টন আর সেগুনবাগানের মধ্যকার মাঠে শেষ বিকেলে আমাদের দু’জনের সঙ্গীতালাপের স্মৃতিকথা বলে ওই গানখানিই গেয়েছিলাম। এই গানটি দিয়ে দাদা-নূরু-মাক্কী পরিবারের সবার সঙ্গে আমার বন্ধন অটুট হয়ে আছে। কমু, হেমন্তের গাওয়া ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা শোনো, রূপকথা নয় সে নয়’ আর ‘রানার’ গানেরও ভক্ত ছিল। সেই সময় দিয়েই সুচিত্রা মিত্রের রেকর্ডের এপিঠে-ওপিঠে ‘হয়তো তাকে দেখনি কেউ’ আর ‘হয়ত তাকে কৃষ্ণকলি বলে কবিগুরু তুমি চিনেছিলেন’ গান বেরিয়েছিল। এই কাহিনী গানগুলো কমুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। আমাদের এক বন্ধু জামিল চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ওর। শেষ দিকে আমাদের চেনা সেই কমু অসুস্থ হয়ে বড় কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। মাক্কী-নূরুদের আর একখানা প্রিয় গান ছিল, কাননদেবীর গাওয়া ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে’। আরও পরে, ওরা ফিরে ফিরে শুনতে চাইত ‘ওগো সুন্দর, মনের গহনে তোমার মুরতিখানি/ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়’...। মাক্কীর ছেলে বাচ্চু বিদেশ যাবার আগে আমার অনেকগুলো পুরনো গান ক্যাসেটে তুলে নিয়ে গেছিল। এত শুনেছে যে ঘষা-ঘষা হয়ে গেছে নাকি সেসব গানের আওয়াজ। নূরুদের সঙ্গে পরিচয় হবার আগেই কিন্তু মাক্কীর সঙ্গে আমার ঘোর বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। পরিচয় ঘটেছিল অদ্ভুত এক পরিবেশে। আগে আমরা ফজলুল হক হলের গেট হাউসে থাকতাম। আব্বু হাউস টিউটরের কাজ ছেড়ে দিয়ে সেগুনবাগানের বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু সরকার রিকুইজিশন করা ওই বাড়ি না ছেড়ে আমাদের জন্য ৪২ নম্বর তোপখানার একখানা রিকুইজিশন করা বাড়ির দোতলা বরাদ্দ করলেন। সেখানে থাকতেই কলেজে ঢুকেছি। ওই বয়সে তখন স্বাধীন হবার জন্য মনটা তো ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। একখানা পিস্তল হাতে পেলে দারুণ হতো, এসব ভাব মনে জাগছে। একতলার বাসিন্দা রাঙাদির কাছে মনের বাসনা-টাসনার কথা খুলে বলি। রাঙাদি বললেন, শোনো-পিডব্লিউএনজি (পাকিস্তান উইমেনস ন্যাশনাল গার্ড)-তে যোগ দেবে? আমি তো যাই। ওখানে ট্রেনিং নিলে, শেষে ওরা সবাইকে একটা করে পিস্তল দেবে শুনেছি। আর কথা কী? রাজি হয়ে গেলাম। রাঙাদি আমার জন্য ভর্তির আবেদনপত্র নিয়ে এলেন। পূরণ করে আব্বুর কাছে অভিভাবকের স্বাক্ষর নিতে গেলে তিনি বললেন, কি লিখেছে-টিখেছে ভাল করে পড়েছ? লিখেছে কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধে যেতে কোন আপত্তি নেই! এ সব শর্তে তো সই করে দিতে হবে। আব্বুর সামনে থেকে সরে এসে আম্মুর কাছে দরবার চলল। আম্মুকে বোঝালাম, ওসব যুদ্ধ-টুদ্ধ কবে হবে তার ঠিক নেই, এখন অস্ত্র চালানোটা শিখে নিলে দোষ কি? উৎসাহে তো তখন টগবগ করছি, আমাকে দমানো কঠিন! শেষ পর্যন্ত আম্মুর তাড়নায় আব্বু সই করে দিলেন। মঙ্গল আর কি বারে যেন রেসকোর্সের মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে প্যারেড করতে যেতে হতো। ওসব লেফট-রাইট তো জানাই ছিল, কেবল ভারি অস্ত্রটা দেবে কবে? একবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেবার তোড়জোড় শোনা গেল। পিডব্লিউএনজিরও ডাক পড়ল। তখন আমাদের হাতে বন্দুক দিয়ে প্যারেড করতে করতে প্রেজেন্ট আর্মস ইত্যাদি করে স্যালুট করতে শেখানো হলো বন্দুকটা যেই ভারি! ও হাতে নিয়ে আবার মার্চ! এমনিতেই ল্যাগবেগে শরীর। যে হাতে বন্দুক নিয়ে সে কাঁধ ঝুলে পড়ে। সে কী দুরবস্থা! পাশের জনের সঙ্গে এক লাইনে চলতে পারি না, পিছিয়ে পড়ি। ট্রেনিং দাতারা ভাবতে লাগল আমাকে গার্ড অব অনার থেকে বাদই দিতে হবে। তাহলে আবার একজনের জুড়ি থাকে না। কি আর করা, শেষে স্যালুটের প্রথম লাইনে না-পড়ি এমনিভাবে আমাকে দাঁড়াতে বলা হলো। এতসবের পরে তো সাধ মিটে গেছে। রাঙাদিকে কেবলি খোঁচাতে লাগলাম, বা রে! পিস্তল কোথায়? ধীরে ধীরে প্যারেডে কামাই করা শুরু হলো। এই পিডব্লিউএনজিতেই মাক্কীর সঙ্গে দেখা। তিনিও ওই এক কাঁধ নামিয়েই বন্দুক হাতে প্যারেড করতেন! রাঙাদি একদিন বললেন দলের মেয়েরা একটা অনুষ্ঠান করবে, থাকবে নাকি ওতে? সে আর মন্দ কি? একটা ট্যাবলো আর কী একটা নাটক যে হয়েছিল। গানটান করেছিলাম হয়তো, অত কথা মনে নেই। মহাড়ার অবসরেই ভাব হলে গেল মাক্কীর সঙ্গে। ও আমার গলা জড়িয়ে ঘাড়ে হাত রেখে পায়চারি করতে করতে সায়গল আর কানন বালার করা হিন্দী সিনেমার গল্প বলত বুঁদ হয়ে। তার পর থেকেই পুরানা পল্টনে মুকুল ফৌজের আমাদের বোন ফৌজ শাখায় প্যারেড, ব্রতচারী এসব করিয়ে ফিরতি পথে মাঠে বসে মাক্কীর সঙ্গে গান হতো। ততদিনে সেগুনবাগানের বাড়িতে চলে এসেছি। পুরানা পল্টন আর সেগুনবাগানের ভিতরকার মাঠটাই ছিল আমাদের মিলন স্থান। মাঠের উত্তর দিকে ‘বেলা কুটির’ নামের একটি একতলা বাড়ি থেকে তিন ছেলেমেয়ে সঙ্গে করেও আসত। হায়দার বুড়ি আর বাচ্চু এই তিনজনের বড়টা ধীরভাবে মায়ের পাশে পাশে হেঁটে আসত। বড়ি একগাল হাসি নিয়ে মায়ের এক হাত জড়িয়ে লাফাতে লাফাতে আসত। ছোট বাচ্চু চুপচাপ আসলেও ওর বুদ্ধিতে ঝকঝকে চোখে চেয়ে থাকত। চুলগুলো একটু ছোট করে ছাঁটা আর মাথা ঝাঁকিয়ে কপালের চুল সরাত। আজ সখী মাক্কীও নেই ওর বড়টা হায়দারও নেই। আমাদের সঙ্গীসাথীরা তো বটেই ছেলেপুলেও পটাপট চলে যাচ্ছে। এখন নূরু দাদা আর আমি কে যে কখন যাই!! নূরুর গল্প রয়ে গেছে আরও একটু। পঞ্চাশ-একান্ন সালে ইডেন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। বিজ্ঞানের ছাত্রী নূরুরা ভোর সাতটা-সাড়ে সাতটায় ইডেন কলেজের ঘোড়ার গাড়ি করে চড়ে ঢাকা কলেজে গিয়ে বিজ্ঞান পড়ত, প্র্যাকটিক্যাল করত। আর্টসের আমার দশটা নাগাদ বকশিবাজার ইডেন কলেজে গিয়ে লজিক, ইকোনমিক, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক ইত্যাদির ক্লাস করতাম। দুপুরের পরে ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞানের মেয়েরা ফিরে টিফিন খেয়ে, ইডেনে ইংরেজী আর বাংলার ক্লাস করত আমাদের সঙ্গে। নূরুদের বাসায় গিয়ে একদিন শুনলাম, রোজই টিফিন নিয়ে গিয়েও না খেয়ে ফেরে আমার বন্ধু। ওর স্বামী আমাদের কমন ভাইজান আমাকে বললেন, শোনো ঢাকা কলেজে গিয়ে ব্যাঙ কেটে হাতে চর্বি আসে বলে ওই হাতে খেতে ওর ঘেন্না করে। তুমি ওকে খাইয়ে দিতে পার না? সে কি কোন কথা? পরদিন থেকে নূরু ইডেনে ফিরলে আমি ভাল মতো হাত ধুয়ে ওকে টিফিন খাইয়ে দিতাম। কিছুদিন পরও হঠাৎ একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, সবসময় দেখেছি তোর নখ একদম পরিষ্কার থাকে। এতদিনে বুঝতে পারছি, সেই জন্যই আমার হাতে খেতে ওর ঘেন্না হতো না। নূরু এখন ‘ছায়ানটের’ সহসভাপতি। কাজে-কর্মে কতকাল আমরা একসঙ্গে চলছি। অনুষ্ঠানের সময় কোথায় কোন টব হবে, কোথায় কোন ছাদে ফুল সাজাতে হবে, আমার টেবিলে কাগজপত্রের স্তূপ কোন ড্রয়ারে ঢুকে যাবেÑ সব এমনকি করবেই নূরু। টেবিলের টেলিফোনটাও ঢুকিয়ে দেবে কোথায় জানে! বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সাজসজ্জাতে সারাদিন ব্যয় করে দেবে, মাথা ঘুরলেও একটু বসে আবার হাত দেবে কাজে মনে হচ্ছে আমাদের নূরু। কলেজের প্রথম বর্ষে বেশ দেরি করে এসে ভর্তি হয়েছিল মনিমুন্নেসা। শেষ রোল নম্বরটা ছিল ওর-চুয়াত্তর। সে সূত্রেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এবারের বন্ধুত্ব রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে। কলেজের আপিসবাড়ির ভেতরমুখী একঘরে একখানা পিয়ানো ছিল। ওখানে ছাত্রীরা কেউ ঢুকত না। মনি একদিন পায়ে পুরনো পিয়ানোর ঢাকনা তুলে রিড টিপে টিপে দেখে দিব্বি বাজছে সেটা। তারপর থেকে ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে মনি’র পিয়ানো বাজনার সঙ্গে গান গাওয়া শুরু হয়ে গেল। ‘কেন পান্থ য়ে চঞ্চলতা’, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ বাজনার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে কী যে ভাল লাগত! এখন পিয়ানোর সঙ্গে গাইবার নেশা ধরে গেল বেজায়রকম। দেয়ালের ওপাশে অধীর লোকজনের এদিকে খেয়াল থাকত না। আর টিচারদের প্রিন্সিপ্যালের রুম ছিল ‘বাগান’ নামধারী একটা ফাঁকা পরিসরের ওপারে। কেউ কিছু টের পেত না। বড় আনন্দে কেটেছিল সেই দিনগুলো। ওই ঘরটিতে বড় টেবিল ঘিরে কিছু চেয়ার রাখা ছিল। আমাদের প্রথম মানের শিল্পী আফসারী খানম। উনি একদিন কলেজে এসেছিলেন ফেরদৌস আপার সঙ্গে। আমাদের, যাকে বলে নিবর্ন্ধাতিশয্যে, চোখ দুটো স্বপ্নময় করে দূরে দেখার মতো করে চেয়ে থেকে গাইলেন- ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে/বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে’। ভাবে টইটম্বুর ওই গান শুনে ভারি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর মনে হয়েছিল এরকম কণ্ঠের গাইয়েকেই বুঝি বলে ‘স্বর্ণকণ্ঠী’। আব্দুল আহাদ ভাইয়ের এই প্রিয় ছাত্রীটি সত্যি অপূর্ব গাইতেন। আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চল ছিল ভালই। তবে মনির পিয়ানোর সঙ্গে গাইতে গাইতেই যেন রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি টান বেড়ে গেল। ওদিকে কলেজে পড়ারকালেই সোহরাব ভাইয়ের কাছে গান শিখতে আরম্ভ করেছিলাম। উনি নজরুলের ‘এ কোন্ মধুর শরাব দিলে/আল্-আরবী সাকী’, ‘খোদার প্রেমের শরাব গিয়ে,/বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে, হায়’, ‘তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে’, ‘সেদিন বলেছিলে এই সে ফুলবনে/আবার হবে দেখা’ এসব গানের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক, পল্লীগীতি ইত্যাদি সবই শেখাতেন আমাকে। বছর তিনেক একটানা শিখেছি তাঁর কাছে। আম্মু সোহরাব ভাইকে অত্যন্ত ভালেবাসতেন। ওঁর প্রথম সন্তানের জন্মের পরে উনি এসে লাজুক ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আমাদের বললেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অমনি আমরা সবাই হইহই করে ছেলের নাম রেখে ফেললাম-‘স্বপন’। পরে জেনেছিলাম ও নামের কোন খবর নেই, ওদের বাড়িতে সবাই ডাকে ‘মোয়াজ্জেম’। আম্মু সেই ছেলের জন্য উল দিয়ে জামা, মোজা আর টুপির সেট বুনে দিয়েছিলেন। সে কথা সোহরাব ভাই স্মরণ করেন এখনও। আর, গ্রামের বাড়িতে থাকতে ভাবী নাকি সোহরাব ভাইয়ের বেতনের সব টাকা সাবধানে স্বপনের একটা মোজার ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। রাতে চোর এসে গুছানো ওই টাকাগুলো মোজাসুদ্ধ নিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সোহরাব ভাইয়ের কাছে পান শিখেছি বলে তাঁকেই আমি গুরু বলে মানি এখনও। সোহরাব ভাইয়ের শেখানো ‘দুজনাতে যদি এ জীবনে আর দেখা নাহি কভু হয়,/মুছে যাবে সব, পড়ে রবে শুধু দুদিনের পরিচয়’ আধুনিক গানখানিই আমি আমার প্রথম রেডিও প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সে সময়কার আধুনিকের কথা আর সুর দুই-ই বেশ ছিল। ভাল লাগত গাইতে। আমার রেডিওতে গান গাইবার পূর্ব কথাও দারুণ মজাদার। অডিশন শুরু হবার সঙ্কেত হিসেবে দরজার ওপরের লাল বাতিটি জ্বলে উঠলেই বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠত। ফলে গান হতো কাঁপা কাঁপা। তার ওপরে গলাটাও ছিল অল্প বয়সের মেয়েদের মতো অতি মধুর এবং অপরিণত। অথচ আমার কলেজ জীবনের সময়ের কথাই এসব। ফলত, একে একে সাতবার অডিশনে ফেল!! রবার্ট ব্রুসের মতো দুঃখদশা! একবার তো অডিশনের পরে রেডিওর কর্মকর্তা আমিরুজ্জামান খান এসে আমাকে বললেন ইউ আর এ লিট্ল কিড আর একটু বড় হয়ে এসো! হায়রে কলেজ গার্লের দুর্দশা। এবার ভয় কাটানোর জন্য রেডিওতে নাটক করব স্থির করলাম। এইবারে অডিশন পার হয়ে নাটকে অংশ নেবার সুযোগ হলো। লাল বাতির ভয় চলে যায়নি, তবে দলেবলে নাটকে কথার পিঠে কথা হতো বলে গল্পে ঢুকে ধক্ করে ওঠার ব্যাপারটা কমে এলো। মধুর কণ্ঠের দৌলতে, প্রায় বছর দুই হবে, দিব্বি নায়িকা-টায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করা গেল। তার পর কোথায়, পাস করা গেল গানের অডিশনে! এখানকার ছেলেমেয়েরা এ গল্প জেনে হাসতে হাসতে মরবে সব। নাটক অভিনয়ে সাফল্য এসেছিল ভালই। মাসে দুবার নাটক করার আহ্বান পেতাম। বারকয়েক গান গাওয়ার পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। তখনকার দিনে যে ব্যক্তি নাটক করত সে আর রেডিওতে গান গাইতে পারত না। অগত্যা নাটক করাই বন্ধ করা গেল। কিছুকাল পার হলে নামকরা নাট্যপ্রযোজক নাজির আহমদ বিদেশ থেকে ফিরলেন। আমার অভিনয়ের প্রশংসা শুনলেন রেডিও আপিসে। রণেন কুশারী আমার সংলাপ বলা পছন্দ করতেন। বলতে শুনেছি, কেমন টাশ টাশ কথাগুলো! অর্থ ভাল না বুঝলেও প্রশংসা যে, তা বুঝেছি। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আবত্তি করার জন্য আমন্ত্রণ পেলাম একবার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এর অংশবিশেষ বাছাই করে আমাকে তৈরি করে নেয়ার ভার ছিল বোধ করি নাজির আহমদের ওপরে। উনি নিজে কর্ণ পড়বেন। আমাকে কী চমৎকার করে যে কুন্তীর পাঠ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম জেনেছিলাম, ‘ওই পরপারে/যেথা জ্বালিতেছে দ্বীপ স্কন্ধাবারে/পান্ডুর বালুকা তটে!’ সংলাপ বলার জন্য পরপারের দূরত্বটা কেমন করে উচ্চারণের সুরে ঘনিয়ে তুলতে হয়। যেন বলার ভঙ্গিমাতে অপর পারের দূরত্বটা ছবির মতো ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। আঙ্গুল তুলে দূরত্বটা একেবারে দেখিয়ে দেয়া হলো যেন! ভারি অবাক হয়েছিলাম!! চট করে সংলাপের সুর ধরে নিতে পারি, শুনেছিলাম আগেই। এবার প্রত্যক্ষ জেনে রেডিওকে দিয়ে নজরুলের ‘মেহের নিগার’-এর নায়িকা হবার জন্য ডাকলেন আমাকে। শুনেছিলাম উনি নিজেই নায়কের ভূমিকা করবেন। কী ভেবে কে জানে মুজিবর রহমান খানকে নায়কের ভূমিকার জন্য আনানো হলো। এর উর্দু উচ্চারণ নিয়ে বিপাকে পড়তে হলে নাজির আহমদকে। ‘শাহজাদা’ সম্বোধন করতে আ-কারগুলো টেনে উচ্চারণ করে সম্মানের সুর শেখাতে চেষ্টা করলেন নাট্যনির্দেশক। আর নায়ক বলে চলেন ‘শাহ্জেদা’। ঝালাপালা দশায় পড়ে নাজির আহমদ ঘচাঘচ করে কেটে সংলাপ ছোট করে নিলেন। ‘মেহের নিগার’-এ মুহুর্মুহু গান ছিল। লায়লা আরজুমান্দ বানু সেসব গান গেয়েছিলেন। আমার দুঃখ হয়েছিল, আমি কেন ওই দক্ষতায় গানগুলো গাইতে পারি না। সোহরাব ভাইয়ের কাছে গান শিখেছি অথচ এই গানগুলো গাইবার ক্ষমতা নেই। নাটক করা তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু অমন গান? দুঃখ যত গভীরই হোক, এ কথাও ঠিক যে ওস্তাদ গুল মহম্মদ খাঁ সাহেবের কাছে বিশুদ্ধ সঙ্গীত শিখে, রীতিমতো সাধনা করে লায়লাদি ঝকঝকে করে মেজে সুরে ভরে নিয়েছিলেন আপন কণ্ঠখানি। তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা কী! কলেজ জীবনের আর কিছু নাট্য-রঙ্গ লিখে স্মৃতিচারণ শেষ করব এবার। রবীন্দ্রনাথের ‘শোধবোধ’ করা হয়েছিল একবার। নায়কের ভূমিকাটাই ছিল বুঝি আমার। নাকি উমেদা-র? গুলিয়ে যাচ্ছে একেবারে! উমেদাই হবে। পুরো নামটা বোধ করি উম্মি দওয়ারা....। আমরা উম্মেদা ইসলাম জানতাম। দোহারা গড়নের উমেদার চোখ ছিল বড়, বড় বড় পাপড়ি ঘেরা। অভিনয়ের সঙ্গে চাহনির কায়দা মিলে বেশ আকর্ষণীয় হয়েছিল ভূমিকাটি। তারপর সে কী সর্বনাশ। সেই অভিনয় দেখে আমাদের ক্লাসের ‘সাজেদা’ ধুম প্রেমে পড়ে গেল সেই উম্মিদ ওয়ারার! যন্ত্রণা কাকে বলে! নাটক শেষ হয়ে যাবার পর সাজেদা ওর দিকে তাকায় আর ‘উহু উহু’ ভাবের এক ভঙ্গিতে শিউরে উঠে ভয়ে কুঁকড়ে লজ্জায় মরে যায়। এ নিশ্চয়ই মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। নইলে এমন অস্বাভাবিক কা- হয়! মেয়েটি বোধকরি পরাশ্রিত ছিল, লেখাপড়াতেও দুর্বল আর বেজায় স্বাস্থ্যহীন। শেষমেশ তার কী হয়েছিল, সে আর জানতে পারিনি। এই হচ্ছে কলেজের নাট্যরঙ্গ। কলেজে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল, রবীন্দ্র জন্মতিথি উপলক্ষে মনে হয়। কারা যেন ‘অভিসার’ আবৃত্তির সঙ্গে অভিনয় করেছিল। এ অনুষ্ঠান হয়েছিল শিক্ষকদের বসার ঘরের উত্তরের দেয়ালের বাইরে একটুখানি জায়গায়। সেদিকটায় কতকগুলো সিঁড়ি ছিল। ছাত্রীরা বসেছিল সেইখানে। সামনের দিকে পাতা চেয়ারে বসেছিলেন শিক্ষকরা। তার উত্তরে তক্তপোষ পেতে হয়েছিল মঞ্চ। এ অনুষ্ঠানের সকলে মিলে অনুরোধ আর কাকুতি-মিনতি করে আহাদ ভাইয়ের বোন, আমাদের হামিদা আপাকে দিয়ে গান গাইয়েছিল। কী সুন্দর গলা আর রাবীন্দ্রিক ভাব! গেয়েছিলেন, ‘চিনিলে না আমারে কি চিনিলে না।’। সেদিনের মুগ্ধতা আজও স্মরণ করতে পারি। হামিদা আপার লজিক ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে আমি আর আয়েশা (ডাক্তার বদরুদ্দোজার বোন) রোজ পুরনো গান নিয়ে টুক টুক করে কথা বলতে বলতে সুর ভাজতাম। একদিন অসাবধানতা বশে গলা উঁচু হতেই হামিদা আপা ডেকে বললেন, ‘লাস্ট বেঞ্চ বলো...। ক্লাসের পড়া ধরে বসলেন। কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। ‘তুমি বলতে পারবে? না? তুমি বলতে পারবে? দুজনেই তো আকাশ থেকে পড়েছি নিচে। হামিদা আপা আর কিছু না বলে, ফিরে ক্লাসের পড়া বুঝিয়ে বললেন। সাত জন্ম শুনিনি, এখন মাঝখান থেকে কীইবা বুঝব। তবু মন দিয়ে শুনলাম। আবার পড়া ধরলে যাহোক কিছু বলার চেষ্টা করলাম। উনি শান্ত স্বরে বললেন, ক্লাসে পড়া শুনবে। ব্যাস্। আর নষ্টামি করি?’ পরদিন থেকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা শুরু হলো। তারপর কি একটা লিখতে দিয়েছিলেন ডিডাকটিভ লজিকের, আমাকে ভাল নম্বর দিলেন। শাসনের এই পদ্ধতি বড় চমকপ্রদ নয়? হামিদা আপা ছিলেন ইতিহাসের নারী প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ সাহেবের স্ত্রী। হামিদা আপাকে কখনও কণ্ঠস্বর চড়িয়ে কথা বলতে শুনিনি। সেদিন অনুষ্ঠানে তাঁর ধীর শান্ত অনুচ্ছ কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বড় বিমোহিত হয়েছিলাম সত্যি। অল্পদিন হলো তাঁর প্রয়াণ হয়েছে। ‘ঝরা বকুলের গন্ধ’ এই অসামান্য নামে তাঁর স্মৃতি কথাটি অতি চমৎকার। ইডেন কলেজে ছিলেন ভাইস-প্রিন্সিপাল, কিছুদিন পরে সেই ইকোনমিক্স কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল হয়ে কলেজটিকে করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশাসন চালাবার ক্ষেত্রে তিনি চলতি বছর অনুসরণ না করে, সংযত নি¤œ কণ্ঠেই ধীর-স্থির দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায়? কলেজের আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে এবং সমাপ্তি ঘটে যাক। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের স্ত্রী কলেজ পরিদর্শনে এসেছিলেন ৫১ সালের কথাÑ ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন। বিএ ক্লাসের সাঈদা আপা দারুণ স্পিরিটেড মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খেপিয়ে তুললেন ক্লাসের সবাইকে। বললে কিছুতেই স্বাগত জানানো হবে না। মহিলা ওঁদের ক্লাসে ঢুকতেই এঁরা চেঁচিয়ে উঠলেনÑ শেম্ শেম্ ॥ এদিকে আমার বান্ধবী আমিনা মাহমুদ কোথা থেকে বাঁদর নাচের এক ডুগডুগি যোগাড় করে একতলায় অঙ্কের ‘মালা’ স্যারের (নাম জানি না) ক্লাসের বারান্দায় গিয়ে ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ বাজাতে শুরু করল। মালা স্যার হেসে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কলেজের প্রিন্সিপাল ক্ষেপলেও একটা রগড় হয়েছিল বটে সেদিন। সেই বয়সে আমরা মোটেই গুরুগম্ভীর ছিলাম না কেউ। বয়সের দোষ বলে কথা।
×