ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবু আফজাল সালেহ

সন্জীদা খাতুনের সুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৫ এপ্রিল ২০১৯

সন্জীদা খাতুনের সুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার

সনজীদা খাতুন। ডাকনাম ‘মিনু’। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। পরে ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে সভাপতি। ছায়ানট-বাংলা নববর্ষ আর সনজীদা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের ব্যক্তিত্ব। শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রমনা বটমূলের বাংলা নববর্ষের উৎসবকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সঙ্গীতাঙ্গনকে নিয়ে যাচ্ছেন ‘আলোর অগ্রবর্তিকা’ হয়ে। তিনি একাধারে কবি, শিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক। হয়েও তাঁর প্রতিভার ঝলকের স্থায়িত্বে আমরা গর্বিত। ১৯৬১ সাল থেকেই সনজীদা খাতুনসহ অনেকে ‘শ্রোতার আসর’ নামে ঘরোয়া আসর বসাতেন। তারা অনুভব করেছিলেন, দেশে চর্চার সঙ্কট রয়েছে, রয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর অভাবও। এই অভাব দূর করতে হলে প্রয়োজন একটি রবীন্দ্রচর্চার প্রতিষ্ঠান, প্রয়োজন একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ের। সনজীদা খাতুনসহ আরও অনেক অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। বাঙালী সংস্কৃতির পিঠস্থান ‘ছায়ানট’ ও তার নাম একই সমান্তরালে বয়ে গেছে। সনজীদা খাতুনের সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে কাছে থেকেই লিখেছেন অনেকে। জিয়া হায়দারের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। দাউদ হায়দারের এ লেখার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে কিভাবে একটি অনুষ্ঠানকে সংগঠিত করতে হয়। সনজীদা স¤পর্কে কবি দাউদের মূল্যায়ন ছিল এ রকমÑ ‘একটা মানুষের ভেতর কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে ছোট একটি আয়োজনকে জাতীয় থেকে বৈশ্বিক রূপ দেয়া যায়। ছায়ানটের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে বহু চেষ্টা করেছে অপশক্তি। রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে স্তব্ধ করতে চেয়েছে বাঙালীর মাঙ্গলিক সুরকে। তা পারেনি; পারবে না। সনজীদা খাতুনের দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা সামনে নিয়ে যাবে ছায়ানটকে, যাবে বাঙালী সংস্কৃতিকে।’ এছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী একটি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতি। ঢাকায় ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল বিরলপ্রজ এ সংগঠক জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতাঙ্গনে শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত প্রোথিত। বর্তমানে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত মুখ হচ্ছেন সনজীদা খাতুন। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুনে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেন। তৎকালীন সরকারের দাবিÑ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতি নয়। আমরা মুসলমান।’ অসাম্প্রদায়িক এ মনোভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন পেশার লোকজন ছিলেন এ সাহসী আন্দোলনে। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রচর্চায় এগিয়ে আসেন। ফলে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ রবীন্দ্রনাথের এ গানটি সভা-সমাবেশে পরিবেশনের ওপর জোর দেন এবং স্বাধীনতার পরবর্তী জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠানের। উদ্যোক্তা ছিলেন গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ সনজীদা খাতুন ছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী। তিনি মঞ্চে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তাকে বলা হলো ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। কারণ তিনি চাইছেন পাকিস্তানীদের কাছে ‘সোনার বাংলা’র প্রীতি ও ভালবাসার জানান দিতে। সনজীদা খাতুনের ভাষ্যে, বেকায়দা হলো, কারণ অত লম্বা পাঁচ স্তবকের গানটি তাঁর মুখস্থ ছিল না। পরে গীতবিতান-এর সাহায্যে বড় গানটি গেয়েছিলেন। গানটি বাঙালীকে কতখানি আবেগতাড়িত করে, সেটি বোঝাবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাংস্কৃতিক বিষয়ক বেশ কিছু সফল সংগঠন তিনি সৃষ্টি করেছেন। সাংস্কৃতিক বিকাশে তিনি করেছেন প্রচুর গবেষণা। গবেষণার বাইরেও তিনি কাজ করেছেন। নিজের জীবন ও বাঙালীর জাতীয় জীবনের সাংস্কৃতিক মর্মমূল উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন। প্রকাশ করেছেন সংগঠনের মাধ্যমে, ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আর সৃষ্টি করেছেন ১৬টি গ্রন্থ। তার প্রবন্ধ/গবেষণামূলক গ্রন্থাবলী হচ্ছে- কবি সত্যে›ন্দ্রনাথ দত্ত (১৯৫৮) রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবস¤পদ (১৯৮১) ধ্বনি থেকে কবিতা (১৯৮৮), তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, জননী জন্মভূমি, প্রভাতবেলার মেঘ ও রৌদ্র, অতীত দিনের স্মৃতি এবং সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে-এর মতো প্রবন্ধ গ্রন্থাবলীর। এছাড়া স¤পাদনা করেছেন-স্মরণ (যৌথ ১৯৬৬); সঙ্গীত সংস্কৃতি (১৯৮১); আপনজনদের স্মৃতিকথা (১৯৯৭)। সনজীদা খাতুন ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তার জীবনের পুরো সময়ই কাটিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লোক সঙ্গীত প্রসারের জন্য। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাতে তিনি নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে মেনে নেয়নি; বাঙালী সংস্কৃতি বিকাশের ‘অপরাধ (!)’-এ কলেজে শিক্ষকতাকালে তাকে ঢাকা থেকে বদলি করা হয়েছিল রংপুরে। কিন্তু তার মনোবল ছিল পাহাড়ের মতো অটল, বাংলা সাংস্কৃতিক বিকাশে ছিলেন অবিচল, নাছোড়বান্দা। সে জন্য ২০০১-এ রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে ভয়ঙ্কর বোমাবর্ষণের পরও তিনি বলতে পেরেছেন ‘বাঙালীর সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চলবেই...।’ ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে প্রথম বাংলা একাডেমির (বর্ধমান হাউস) বারান্দায় সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন সনজীদা খাতুন ও ফরিদা মালিক। সে বছরে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৭০ বঙ্গাব্দে ১ বৈশাখ-এ (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ) তৎকালীন ইংলিশ প্রিপারোটরি স্কুলে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। সবগুলো বিভাগ তিনি শক্ত হাতে তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি সর্বদাই প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাঙালিত্বের বোধ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। সনজীদা খাতুনরা তখন মানুষের ঐতিহ্যপ্রীতি বাড়াতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করার রীতি শুরু করেন। তবে শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৯৭১ সাল ছাড়া প্রতিবছরই রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উদযাপন করে আসছে ছায়ানট। ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষে বাংলা নববর্ষের আহ্বান। ছায়ানটের গ-ি ছাড়িয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ দু’বাংলায় ১ বৈশাখে স্বতঃস্ফূর্ত জনঅংশগ্রহণ। সরকার এর সার্বজনীন রূপ দিতে কর্মচারীদের নববর্ষ ভাতা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে একটি দিন সব বাঙালী একত্রে একটি উৎসব পালন করতে পারে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিক কর্মকা-ের স্বীকৃতিস্বরূপ দু’বাংলাতেই বিভিন্ন পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ ‘একুশে পদক’ (১৯৯০)। পেয়েছেন সাহিত্যক্ষেত্রের আরেক মর্যাদাবান পদক ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৯৯)। আরও পেয়েছেনÑ ‘নজরুল স্বর্ণপদক’ (১৯৫৪); ‘সাদত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৯৮); ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ (২০০০)। ওপার বাংলা থেকেও অনেক পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন বিরলপ্রজ এ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। কর্মময়তার স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ পদক প্রদান করেছে। এছাড়াও তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৮৮); কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি (১৯৮৮) পেয়েছেন। সনজীদা খাতুন ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তার জীবনের পুরো সময়ই কাটিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লোকসঙ্গীত প্রসারের জন্য। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাতে তিনি নেতৃত্ব দেন। জীবনভর অশুভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং করছেন। মানবিক ও মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে রেখে চলেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে দীর্ঘ পথ হেঁটে যাচ্ছেন সম্প্রীতির পথে। সুরকে হাতিয়ার করে আজও লড়াই করছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। অশুভের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ তার।
×