ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনা রোধে সিদ্ধান্তের পর সিদ্ধান্ত, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না;###;আলোর মুখ দেখে না

সড়কে নৈরাজ্য থামছে না

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৫ এপ্রিল ২০১৯

সড়কে নৈরাজ্য থামছে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে ২০১৮ সালে। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুর্ঘটনা রোধে সিদ্ধান্তের ১০ ভাগও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হয় না। তাছাড়া সরকারের নীতি নির্ধারণী পক্ষ, মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ ও মালিক-শ্রমিক নেতারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকলেও সিদ্ধান্তের খবর রাখেন না চালকরা। অথচ চালকদের ওপর নির্ভর করে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমেই পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর একটিও শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নামমাত্র কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বাদ বাকি হিমাগারে। তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উপদেষ্টা কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটির নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয় না। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে অন্তত ২৩ দফা নির্দেশনার বেশিরভাগই কাগজে কলমে। পুলিশ যতটুকু রাস্তায় বাস্তবায়ন করে তাই দৃশ্যমান। এর বাইরে সবকিছুই নির্দেশনা পর্যায়েই থেকে যায়। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উচ্চ আদালত ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। সেগুলো বাস্তবায়নের কোন তৎপরতা নেই। পরিবহন শ্রমিক নেতা হানিফ খোকন বলেন, দুর্ঘটনা রোধে অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে। আদালত থেকেও বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোন কাজ নিয়মিত হয় না। কিছুদিন তৎপরতা চলে। পরে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তিনি আন্তরিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে একযোগে কাজ করার পরামর্শ দেন। সর্বশেষ ১৯ মার্চ বাসচাপায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরারের মৃত্যুর পর আবারও নড়চেড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন মালিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবৈধ চালক ও যানবাহনের বিরুদ্ধে যেমন নগরজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে তেমনি পথচারীদের জন্যও আসছে নানান সতর্কবার্তা। অর্থাৎ নিরাপদ থাকতে হলে সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারীদের সতর্ক হয়ে পথ চলার কোন বিকল্প নেই। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বেপরোয়া সড়ক পারাপার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নিরাপদ রাস্তা পারাপার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ঢাকায় অন্তত ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, আমাদের (ট্রাফিক পুলিশ) দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে। বারবার বলছি, কাজ হচ্ছে না। এখন আমাদের কঠোরভাবে আইনী প্রয়োগে যেতে হবে। এখন থেকে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ালে পথচারীর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত এক বছর তিনমাসে রাজধানীতে আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির জন্য দায়ী বেপরোয়া বাসচালক। বাসেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বসুন্ধরায় সড়ক দুর্ঘটনার পর পুলিশ, বিআরটিএ কিছুটা তৎপর হলেও সড়কে নৈরাজ্য থামেনি। প্রতিদিনই বেপরোয়া বাস চালানোর কারণে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তেমনি পুলিশের জালে ধরা পড়ছে ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট না থাকা বাস। সেইসঙ্গে অবৈধ চালকরাও ধরা পড়ছে পুলিশের চিরুনি অভিযানে। কোন চালকের লাইসেন্স নেই, কেউ হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারি যান চালাচ্ছেন, আবার কোন চালকের হাতে একেবারেই ভুয়া লাইসেন্স মিলছে। গতবছরের জুলাই মাসে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় সারাদেশে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। নজিরবিহীন এই আন্দোলনে পরিবহন খাতের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো সামনে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, পুলিশ, গবেষক ও বিআরটিএসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ সদস্যের এই কমিটি করা হয়। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ’ প্রণয়নের লক্ষ্যে এই কমিটি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ কাউন্সিল সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে তখন তিনি বলেন, কমিটি ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব সুপারিশ একে একে বাস্তবায়ন করা হবে। একই সভায় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়নে তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলপথমন্ত্রীকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। এ কমিটিকেও ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে চার স্তরে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে ১১১ সুপারিশ তৈরি করেছে। খসড়া প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে এখন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে টাস্কফোর্স। একটি পৃথক টাস্কফোর্সকে এজন্য দায়িত্ব দেয়া হবে। ট্রাফিক পুলিশ, মহানগর পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সুপারিশ বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। তবে আশঙ্কার কথা হলো বিগত দিনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সর্বশেষ কমিটির সুপারিশ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে কতটুকু আলোর মুখ দেখবে তাই এখন দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি ॥ গত বছরের ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ৫টি নির্দেশনা দেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, দূরপাল্লার পরিবহনে বিকল্প চালক রাখার পাশাপাশি পাঁচ ঘণ্টার বেশি একজন চালককে গাড়ি চালাতে না দেয়া, নির্দিষ্ট দূরত্বে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ, চালকের সহকারীর প্রশিক্ষণ, সঙ্কেত মেনে পথচারীদের রাস্তা পারাপার ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করে কিংবা অবৈধভাবে সড়ক পারাপার বন্ধ করাসহ চালক ও যাত্রীদের জন্য সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়টি পরিবহন মালিক শ্রমিকরা শুরুতেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাকি চারটির মধ্যে দূরপাল্লার রুটে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বাকি তিনটি সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের কোন আলামত নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী। কেন দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, বিআরটিএর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা আমাদের হাতে এসেছিল গত বছর। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। আশা করি আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এজন্য তিনি পথচারীসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ হলো বেপরোয়া গতি। এছাড়াও ইচ্ছামতো পণ্যবাহী পরিবহনের চলাচল, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন অবাধে চলছে। সেই সঙ্গে চালকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, সড়কে মনিটরিং না থাকায় দুর্ঘটনার মাত্রা আরও বেড়েছে। যা সত্যিই আতঙ্কের কারণ। তিনি সড়কে দ্রুত মনিটরিং জোরদার করার দাবি জানিয়ে বলেন, যানবাহনের গতি যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারী পদক্ষেপ ॥ গত বছরের ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের সভায় ‘ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক বৈঠকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, নির্ধারিত স্থানে যাত্রী ওঠানামা, চলন্ত অবস্থায় দরজা বন্ধ রাখাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গতিশীল করতে আরও ডজনখানেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বছরের ২০ আগস্টের মধ্যে এসব কিছুর বাস্তবায়ন শুরুর কথা ছিল। এ জন্য বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), রাজউক, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান থেকে পরিকল্পনা আহ্বান করার পর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা হয়। পৃথক পৃথকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পনা জমা দিলেও তা শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে কেউ জানে না। চার সিদ্ধান্তে তৎপরতা ছিল বেশি ॥ চলন্ত অবস্থায় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখতে হবে, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না। গণপরিবহনের দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম এবং চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ডিএমপি ও বিআরটিএ দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। এছাড়া সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে (সর্বোচ্চ দুইজন আরোহী) বাধ্যতামূলক হেলমেট এবং সিগন্যাল আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা ছিল পুলিশের। যা বাস্তবায়নের দৃশ্য চোখে পড়ে। মহাসড়কে চলমান সব পরিবহনে (দূরপাল্লার বাস) চালক এবং যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার এবং পরিবহনসমূহকে সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা ছিল ২০ আগস্টের মধ্যে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় ৯টি সিদ্ধান্ত এবং পরিবহনের ফিটনেস ও লাইসেন্সের জন্য চারটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সর্বাত্মক প্রচার ও গণমাধ্যমে প্রচার, সভা আয়োজনের পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সড়ক ব্যবস্থাপনায় ৯ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চায়। এ লক্ষ্যে প্রকৌশল, শিক্ষা ও আইন প্রয়োগ এই তিন ‘ই’ বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ কি হয়েছে তা জানা বা দেখভালের কার্যত কেউ নেই। বাসে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি ॥ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৮৭ ভাগই ঘটছে বাসে, ২৯ দশমিক ৬৮ ভাগ ট্রাকে। বাকি প্রায় ৩৮ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে প্রাইভেটকার, জিপ, ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেলে। গত বছরের শেষ তিন মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতর এ তথ্য পেয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তও কাগজে কলমে ॥ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেয়া কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাঝপথে থেমে যায়। সর্বশেষ সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে অন্তত ২০ সিদ্ধান্ত হয়। যার বেশিরভাগই আগে নেয়া ছিল। সেগুলো সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় ফের সেসব সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ আসে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক থেকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধে আরও কঠোর হওয়াসহ ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে কোন অবস্থাতেই গাড়ি চালাতে না দেয়া, বেপরোয়া গতিতে চলা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে স্পিড গান কেনারও সুপারিশ করা হয় বৈঠক থেকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর পরই সিদ্ধান্তের চিঠি পাঠানো হয় সকল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে। উচ্চ আদালতের ২৫ নির্দেশ উপেক্ষিত ॥ ২০১৭ সালের ৬ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিরসনে মহাসড়কের ১০ মিটারের মধ্যে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন হাটবাজার ও বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির অনুমতি না দেয়াসহ ২৫ দফা নির্দেশনা দেয় সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। সড়ক ও মহাসড়কে যানজট এবং দুর্ঘটনা রোধে নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা এক রিট পিটিশনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ নির্দেশনা দেয়। আদালতের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে রাস্তা নির্মাণ বা মেরামতের কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী ছাড়া অন্য কোন সামগ্রী রাস্তার ওপর বা পাশে রাখতে দেয়া যাবে না, যানবাহন চলাচল ছাড়া মহাসড়ক জনসভা বা অন্য কোন কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে না, রাস্তার পাশে পরিকল্পনা মাফিক বাসস্টপেজ স্থাপন করতে হবে, সড়ক মহাসড়কে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে গবাদিপশু পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত খোলা ট্রাক বা লরি ছাড়া সব ধরনের খোলা ট্রাক ও লরি চলাচল বন্ধ করতে হবে, মহাসড়কে গতিরোধক কমিয়ে আনতে হবে এবং গতিরোধকে নিয়মিতভাবে উপযুক্ত রঙ ব্যবহার করতে হবে, যানজট কমানোর জন্য মহাসড়কে স্থান নির্ধারণ করে ফ্লাইওভার ওভারব্রিজ, ওভারপাস বা আন্ডারপাস ও লেভেল ক্রসিং তৈরি করতে হবে, দুর্ঘটনার পর দ্রুত যানবাহন অপসারণের জন্য হাইওয়ে পুলিশকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে আরও কার্যক্ষম করতে হবে। এছাড়া মহাসড়কে পথচারী পারাপারের জন্য উপযুক্ত ক্রসিং নির্ধারণ করে আন্ডারপাস বা ওভারপাস নির্মাণ করতে হবে। যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধে উঁচু লোহার রেলিং দিতে হবে, মহাসড়কে রোড ডিভাইডার দিতে হবে এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে গতিসীমা সীমিত রাখার জন্য রাস্তার পার্শ্বে সাইনবোর্ড লাগাতে হবে, মহাসড়কের ওপর চাপ কমানোর জন্য রেলপথ ও নৌপথের সুবিধা বাড়াতে হবে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গাড়ির মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন করা যাবে না, মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওজন মাপার যন্ত্র স্থাপন করতে হবে। এছাড়াও নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সড়ক-মহাসড়কে রাস্তার পাশে পর্যাপ্ত ড্রেন নির্মাণ করতে হবে, চালকদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক ও পয়েন্ট বেজড ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু এবং তার ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে, প্রতিটি দুর্ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে, মোটরযান মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে, স্কুলের পাঠ্যক্রমে ট্রাফিক রুল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, জনগণকে সচেতন করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে প্রভৃতি। উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন হওয়ার বিষয়টি মাঠপর্যায়ে চোখে পড়ে না।
×