ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বশান্তির বাণী শোনালেন জাসিন্ডা আরডর্ন

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ৫ এপ্রিল ২০১৯

বিশ্বশান্তির বাণী শোনালেন জাসিন্ডা আরডর্ন

১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় ৫০ জনকে। যাদের মধ্যে ৫ জন ছিলেন বাংলাদেশের। এই ঘটনায় বিশ্ববাসীর মনে চরম হতাশা আর ভীতির সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের হামলা বিশ^শান্তির প্রতি হুমকিও বটে। প্রতি বছর বিশ^ব্যাপী সন্ত্রাসবাদের যে সূচক প্রকাশ হয় সেখানে সবচেয়ে তলানিতে থাকে নিউজিল্যান্ডের নাম। দুর্নীতির সূচকেও প্রায় শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি আছে নিউজিল্যান্ডের। অথচ সেই দেশের ওপর এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা যা বিশ^ব্যাপী শান্তিকামী মানুষের মনে নানা প্রশ্নের ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। সবুজ পাহাড়, নীল সমুদ্র আর অনুকূল আবহাওয়ার এই দেশে আছে নির্মল হৃদয়ের মানুষ আর চোখ জুড়ানো প্রকৃতিক সৌন্দর্য। এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর সেদেশের প্রধামনন্ত্রী মমতা আর ভালবাসার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাতে বিশ^বাসী তার মাঝে খুঁজে পেয়েছে শান্তির দূতকে। যিনি হৃদয় দিয়ে ঘটনাটি অনুধাবন করেছেন এবং বিশ^কে দেখিয়েছেন যে কোন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধের জাতী, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভোদাভেদ ভুলে মমতাময়ী দৃষ্টিভঙ্গির যে মাহাত্ম্য তা ছড়িয়ে দেয়া যায় একজন সরকারের প্রধান হিসেবেও। ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, ‘নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিনগুলোর একটি এই ঘটান’ তিনি এই ধরনের হামলাকে ‘নজিরবিহীন সহিংস কর্মকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন। জাসিন্ডা আরও বলেন, নিউজিল্যান্ডে ‘দুষ্কৃতকারীদের কোন জাগয়া নেই।’ তার দাবি, অভিবাসী, শরণার্থীসহ হামলার শিকার হওয়া সবাই নিউজিল্যান্ডের অংশ, কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা নয়। নিউজিল্যান্ডের সমাজে এ ধরনের সহিংস হামলার কোন জায়গা নেই বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেন। তার পর থেকে তিনি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন বিশ^বাসীর কাছে মমতাময়ী, শান্তিকামি অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসেবে। ১৫ মার্চ যে মসজিদে মানুষ নামাজ পড়তে পারেননি, যেখানে ৫০টি প্রাণের রক্ত ঝরেছিল। সেই মসজিদেই ২২ মার্চ শুক্রবার হাজারও মুখের ভিড় জমে। সেখানে ভাষা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। শুধু আল-নূর মসজিদ নয় এর উল্টোদিকের হ্যাললে পার্কে জমেছিল আরও অসংখ্য মানুষ। ঠিক এক সপ্তাহ আগে শে^ত-সন্ত্রাসে নিহতদের স্মরণে প্রার্থনা করল গোটা দেশ। ইসলামকে শ্রদ্ধা জানাতে হিজাব মাথায় দিয়ে হাজির ছিলেন জাসিন্ডা আরডর্ন। তিনি দেখিয়েছেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কিভাবে দাঁড়াতে হয়। তিনি হয়ে উঠেছেন শান্তির বার্তা নিয়ে মথা তুলে দাঁড়ানোর নতুন শক্তি, আদর্শ মানবী। তাকে অনুকরণ করে হাজারো নারী-পুরুষ সেদিন শ্রদ্ধা জানাতে আসে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ যখন নামাজ শুরু করে, বাকিরা তখন তাদের ঘিরে দাঁড়ায়। যেন মানব ঢাল তৈরি করে। মহিলারা অনেকেই মাথা ঢাকেন ওড়নায়। জুতা খুলে খালি পায়ে দাঁড়িয় ছেলেরা। শুধু তাই নয় উইলিয়াম বলে এক বাস্কেটবল অমুসলিম খেলোয়াড় মসজিদে নামাজ আদায় করে। সেদিন সেই হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িতে জাসিন্ডা আরডর্ন বলেন, ‘প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, শোক পালনে আমরা সাবই আজ একজোট। আপনাদের সঙ্গে শোক পালন করছে গোটা নিউজিল্যান্ড।’ এর পর প্রধামন্ত্রীর নেতৃত্বে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এর পর উপস্থিত শোকসন্তপ্ত মুসলিমদের উদ্দেশে ইমাম গামাল ফাওদা বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমরা টিকে রয়েছি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছি। কেউ আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারবে না। এত মানুষের রক্তধারা বৃথা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন ‘যেভাবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার নিন্দা করেছেন, শোকসন্তপ্তদের জন্য এগিয়ে এসেছেন, তা গোটা বিশে^ একটি দৃষ্টান্ত।’ প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অরও বলেছেন, ‘দয়া, সমবেদনা, সহানুভূতি একই শরীরে থাকে। কোন একটা অংশ জখম হলেই গোটা শরীর যন্ত্রণা হয়। আমরা এক। গোটা দেশ শোকার্ত।’ প্রার্থনার পর স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাত ফাতিমা বলেন, ‘ভুলতে পারছি না, এক সপ্তাহ আগে এখানেই জঙ্গী-তা-ব চলেছিল’ পুলিশের ব্যারিকেডে ঘেরা, ফুলের স্তূপের আড়ালে মসজিদের দরজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ফাতিমা আবার বলেন, ‘এটা ভেবেই ভাল লাগছে, আমরা এক। কেউ ভাঙতে পারেনি।’ ২২ মার্চ শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের যোগ দিতে এসেছিলেন অকল্যান্ডেন থেকে ৩৩ বছর বয়সী ফাহিম ইমাম। এক সময় তিনি ছিলেন ক্রাইস্টচার্চের বাসিন্দা। মানুষের ঢল দেখে তিনি বলেন, ‘সত্যিই অকল্পনীয়। কী ভাবে গোটা দেশ, সমস্ত সম্প্রদায় এক জোট হয়েছে। মন ভরে গেল।’ তিনি আরও বলেন, বিমান থেকে নেমে দেখলেন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে একটি লোক। তাতে লেখা ‘জানাজা’। লোকটি জানায়, প্রার্থনা সমাবেশে যারা যোগ দিতে চান, তাদের বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ফাহিম বলেন, ‘ক্রাইস্টচার্চে নেমে একটা অদ্ভুত ভালবাসা অনুভব করলাম এবার। মুসলিম হিসেবে এত গর্ব আগে কখনও অনুভব করিনি। নিজেকে নিউজিল্যান্ডবাসী বলতে পেরেও আমি খুশি।’ মোটকথা জাসিন্ডার মতবাদ শুধু নিউজিল্যান্ডবাসী অনুপ্রাণিত নয় গোটা বিশে^র মানবতা জেগে উঠেতে তার কথা ও কর্মকা-ে। ১৫ মার্চ ঘটনার পর বিদেশের এক চ্যানেলে সাক্ষাতকারে জাসিন্ডা জানান, অভিবাসনের মাত্রা বেড়েছে বলেই বর্ণবিদ্বেষ ক্রমশ বাড়ছে- এই ধারণা তিনি মানেন না। ‘দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের’ ঢেউ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি (জঙ্গী) অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ঠিকই। তবে ওর মতো ধ্যান-ধারণা নিউজিল্যান্ডে আর কারও নেই, তা বলছি না। তবে সেটা ‘নিউজল্যান্ডবাসীর’ স্বার্থবিরোধী।’ জাসিন্ডা মনে করেন, প্রত্যেকেরই একটা দায়িত্ব আছে। তার মন্তব্য, ‘যেখানেই এই মতাদর্শ রয়েছে, তা নির্মূল করতে হবে। এবং এমন কোন পরিবেশ তৈরি করা যাবে না, যেখানে এই ধরনের মতাদর্শ জোরালো হয়ে উঠতে পারে- সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের।’ বিশ^বাসীর উদ্দেশে জাসিন্ডা বলেন, ‘এটা নিয়ে সারা বিশ^কেই ভাবতে হবে। অন্য কোথাও বড় হয়ে ওই বিশেষ মতাদর্শে বিশ^াসী হয়েছে একটি লোক। নিউজিল্যান্ডে হিংসা বয়ে নিয়ে এসেছে সে-ই। যদি সেরা বিশ^কে বোঝাতে চাই যে আমরা সহিষ্ণু এবং সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকায় বিশ^াস করি, তা হলে সীমান্তের বেড়া মাথায় রেখে ভাবা চলবে না।’ এর মাধ্যমে তিনি বিশ^বাসীকে এমন বার্তা দিয়েছেন যা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। শরণার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সকলকে স্বাগত জানাই। বাইরে থেকে এসে যারা নিউজিল্যান্ডকে নিজের দেশ ভাবে, তাদের আপ্রাণ যতœ করি। তার জন্য এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, আমরা এমন পরিবেশ তৈরিতে প্রশ্রয় দিই, যেখানে ওই ধরনের মতাদর্শ লালন করা হয়।’ শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবে অনেক ঘটনা প্রতীকী করে তুলেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডর্ন। ১৫ মার্চের সন্ত্রাসী ঘটনার পর পার্লামেন্টে ‘সালাম আলাইকুম’ বলে কথা শুরু করেন তিনি। শুধু তাই নয় নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোরানের অংশ পাঠ করা হয়। জাসিন্ডার কথা ও মতামতের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তিন মানবতার প্রধামন্ত্রী। তিনি যা করেছেন তা শুধু তার পক্ষেই করা সম্ভব। তিনি প্রমাণ করেছেন শান্তিকামী নিউজিল্যান্ডবাসীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা শুধু তিনিই রাখেন। মসজিদে রক্তপাতের মতো ঘটনাকে তিনি কিভাবে মানবতা দিয়ে সহনীয় করে নিলেন সেটা নিশ্চয়ই আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি। ক্রাইসচার্চের মসজিদে হামলাকারী সন্ত্রাসী সম্পর্কে জাসিন্ডা পার্লামেন্টে জানিয়েছেন, ‘লোকটি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে অনেক কিছু দেখাতে চেয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কুখ্যাত হওয়ার বাসনা,’ তিনি বলেন, ‘আর এই জন্যই আপনারা ওর নাম আর আমার মুখে আনতে দেখবেন না। ও একজন জঙ্গী। ও আপরাধী। ও উগ্রপন্থী। কিন্তু আমি যখন কথা বলব, ও নামহীন। আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, যে ওদের প্রাণ নিয়েছে, সে নয়। তার পরিবর্তে ওর জন্য যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের নাম বলুন।’ এই হচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডর্ন। মুসলিমদের সমব্যথায় ব্যথিত হয়ে সেই সন্ত্রাসীর নাম উচ্চারণ না করার জন্য বলেছেন। আমরা তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে সন্ত্রসকে ঘৃণা করতে শিখব। আর আমরা শাস্তির কথা এলেই উচ্চারণ করব জাসিন্ডার নাম। বার বার উচ্চারিত হবে সেই নাম সবার হৃদয় থেকে। পৃথীবির শাস্তিকামী মানুষের এখন একটি নাম সেটি হচ্ছে জাসিন্ডা আরডর্ন।
×