ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

সপ্তম এসএমই পণ্য মেলা ২০১৯ ও নারী উদ্যোক্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ৫ এপ্রিল ২০১৯

সপ্তম এসএমই পণ্য মেলা ২০১৯ ও নারী উদ্যোক্তা

জাতীয় পর্যায়ে গত ১৬ থেকে ২২ মার্চ সাত দিনব্যাপী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত এবারের সপ্তম এসএমই পণ্য মেলায় নারী উদ্যোক্তারা সেটিই প্রমাণ করলেন। মেলাটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। নারী কিংবা পুরুষ যে কেউ উদ্যোক্তা হতে পারেন। কিন্তু এবারের মেলাটি হয়ে উঠেছিল নারী উদ্যোক্তাদের এক মহা মিলন মেলা। সারাদেশ থেকে মোট ২৮০টি এসএমই উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে। অবাক করার মতো বিষয় ছিল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ১৮৮ জন নারী উদ্যোক্তা এবং ৯২ জন পুরুষ উদ্যোক্তা এতে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ মেলায় ৬৭ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার জোরালো অংশগ্রহণ ছিল। এটিকে যদি আমরা একটি উদহারণ হিসেবে ধরি তাহলে নারীর এই ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের এক অন্য বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়; আমাদের দারুণভাবে আশাবাদী করে তোলে। নারী আজ আমাদের দেশের সকল কর্র্মকা-ের পাশাপাশি দেশের অর্র্থনীতিতে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে সমান তালে অবদান রেখে চলেছেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষকে পিছনে ফেলে যে বহুদূর এগিয়েও গেছে এসএমই মেলার এই অংশগ্রহণ পরিসংখ্যানটি তাই বলে। মেলায় দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য, খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, আইটি পণ্য, প্লাস্টিক ও অন্যান্য সিনথেটিক, হস্তশিল্প, ডিজাইন ও ফ্যাশনওয়্যারসহ অন্যান্য মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের স্বদেশি পণ্যের স্টল স্থান পেয়েছিল। কোন প্রকার বিদেশ পণ্য মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল না। সেই অর্থে এটিকে আমরা নারীর হাতের স্বদেশী পণ্যের মেলাও বলতে পারি। মেলাতে লিখতে পড়তে পারা গ্রামের অতি সাধারণ নারী যেমন অংশগ্রহণ করেছেন আবার অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেওয়া ডক্টরেট করা উচ্চ শিক্ষিত নারীও অংশগ্রহণ করেছেন। তেমনি একজন উদ্যোক্তা রাজশাহীর প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য বুটিকের কর্ণধার ড. ফরিদা পারভীন কেয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। নিতান্ত শখের বসে বছর সাতেক আগে রাজশাহী শহরকেন্দ্রিক তাঁর প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। এখন সেটি প্রায় ৩০০-৪০০ কর্মীর কর্মসংস্থানের এক মহতী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেটি এখন জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও কাজ করছে। তিনি বলছিলেন বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর ক্ষেত্রে নানা রকম চ্যালেঞ্জের কথা; প্রতিকূলতার কথা। কিন্তু তারপরেও শুধু প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মুখের দিকে তাকিয়ে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন এবং এখন তাঁর দৃঢ় সংকল্প যে, যত বাধাই আসুক নারীর কর্মসংস্থানের জন্য হলেও তিনি প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাবেন। তাঁর এই দৃঢ় সংকল্পকে আমরাও সাধুবাদ জানাই। এবারের মেলা সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘এসএমই মেলা উদ্যোক্তাদের জন্য এক বিরাট প্লাটফর্ম। মেলায় এসে মেলা চলাকালীন তাৎক্ষণিক কী বিক্রি হলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যত কাজের ক্ষেত্র পাওয়া। এই মেলা থেকে আমি নিজে প্লাটফর্ম পেয়েছি। বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই মেলার সুবাদেই। কাজেই আমি আশা করব এই মেলা প্রতিবছর সফলভাবেই আয়োজিত হবে।’ এখানে অংশগ্রহণকারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে নানাজনের নানা গল্প রয়েছে। কেউ নিতান্ত শখের বসে, কেউ পেটের দায়ে জীবিকার নানান পথের সন্ধান করতে করতে, আবার কেউ স্বাধীন পেশা বেছে নেওয়ার তাগিদে এই পথে এসেছেন। যেভাবেই আসুন না কেন এই উদ্যোক্তারা দেশের জন্য দুটি মহৎ কাজ করে চলেছেন। এক. নারীর কর্মসংস্থান দুই. দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান রাখা। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখানে অংশগ্রহণকারী এক একজন স্বাবলম্বী উদ্যোক্তার কণ্ঠের যে দৃঢ়তা সেটি সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রের জন্যই একজন নারীর স্বাবলম্বী হওয়া এক দারুণ আশা জাগানিয়া ঘটনা। মেলায় অংশগ্রহণ করা ১৮৮ জন ছাড়াও সারা দেশে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা নীরবে তাঁদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি বলি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন সেটি বল্লেও ভুল হবে না। আমাদের এই উদ্যোক্তাদের পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রাও যোগ করছেন নারী উদ্যোক্তারা। তবে এতসব আশার মাঝে অনেক হতাশাও আছে। এবারের মেলায় নারী বেশি অংশগ্রহণ করেছেন ঠিক আছে কিন্তু সারাদেশের নারী উদ্যোক্তার সংখ্যার কথা যদি বলি সেটি এখনও সন্তোষজনক নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গত বছর করা এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। যার মধ্যে ১০ ভাগের নিচে নারী উদ্যোক্তা। শতাংশের হিসেবে কম হবার বেশ কিছু কারণ আছে। নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে নানা প্রতিবন্ধতার কথা জানা যায়। যেমন- একজন নারী এবং পুরুষ সমান যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও উদ্যোগের শুরুতেই শুধু নারী হবার কারণে সমাজ থেকে এক ভিন্ন আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। পরিবার সবসময় উদ্যোক্তা নারীর পাশে দাঁড়ান না। নারীর জন্য উদ্যোক্তা হবার পথে পুঁজি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যে পলিসিতে পুঁজি যোগান দেয় সেই পলিসিতে নারী উদ্যোক্তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের খাপ খাওয়াতে পরেন না। উদ্যোক্তা হবার জন্য যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। বিদেশে পণ্যের বাজার খোঁজা ও পণ্য রফতানি প্রক্রিয়াটিও নারীদের জন্য অনেকটা দুর্বোধ্য। উদ্যোক্তা হিসেবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বলি আর স্বীকৃতি বলি সেটি সন্তষজনক নয়। যে দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা তরুণের উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখাকে অনেক ক্ষেত্রে পাগলের চিন্তা বলে গণ্য করা হয় সেখানে একজন উচ্চ শিক্ষিত নারীর ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হতে চাওয়া এদেশে যেন এক যুদ্ধ জয় করার মতো ব্যাপার। বাবা-মা ধরেই নেন কন্যা সন্তানকে পড়ালেখা করানো হয় ভাল পাত্রের সহজ সমাধান পাওয়ার জন্য। বিয়ের পর পাত্র পক্ষ যদি চায় বড়জোর কন্যা শিক্ষকতা পেশায় যাবে। এই হচ্ছে বেশিরভাগের দৃষ্টিভঙ্গি। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেওয়া শিক্ষিত নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার হারটি খুবই নগন্য। এত এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে সমস্ত উচ্চশিক্ষিত এবং স্বল্প শিক্ষিত নারী উদ্যোক্তা দুনিয়ায় প্রবেশ করেছেন তাঁদের সবাইকে সাধুবাদ জানাই। হাজারও সমস্যা নিয়েই আমাদের পৃথিবী। বাধা থাকবেই তাই বলে বসে থাকলে চলবে না। পরিসংখ্যান বলি বা সংখ্যা বলি সেটি যেমনই হোক আমাদের অসংখ্য নারী এরই মধ্যে শত বাধার প্রাচীর পেরিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন।কাজেই এভাবেই নারী উদ্যোক্তা সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাবে।আমাদের পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে এবং সেই সাথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নারী উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে তাহলেই নারী-পুরুষ সমতার এক অন্য বাংলাদেশ আমরা পেতে সক্ষম হব।জয় হোক নারীর।
×