ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডিএম তালেবুন নবী

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ও রোগ বালাই নিয়ে নানা কথা

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ৫ এপ্রিল ২০১৯

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ও রোগ বালাই নিয়ে নানা কথা

আম সাম্রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুকুল বা বোল আসা একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আবহাওয়ার কারণে এবার প্রতিটি আমগাছে প্রচুর পরিমাণে মুকুল আসে। যার কারণে এবারের আম চাষীরা খুবই খুশি। পাশাপাশি অধিকাংশ বাগান মালিক নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আম বাগানে লোকসান গুনতে গুনতে তারা হয়রান হয়ে পড়েছিলেন। এবার এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আগের লোকসান এবার পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে বাগান মালিকদের আশা। তাই ইতোমধ্যেই তর তর করে বাগানের মূল্য ওঠা শুরু করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছেড়ে শিবগঞ্জ, কানসাট হয়ে সোনামসজিদ পর্যন্ত বাগানের গাছ-গাছালি সারিয়ে আকাশের দেখা মেলা কষ্টকর। প্রায় ১৫ কিলোমিটার জুড়ে সারি সারি বাগান। শিবগঞ্জে এবার ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আমগাছ থাকায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটলেও আম বাগানের শেষ হবে না। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসব মুকুল ধরা বাগানের নিচ দিয়ে এখনও হেঁটে চলেছেন। এক সময়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গান করেছিলেন তিনি এই অঞ্চল ঘুরেই। লিখেছেন ‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে।’ তার পরের প্যারায় লিখেছেন : ‘ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি’ মনে হবে রবি ঠাকুর এই অঞ্চলের আম বাগান আর ধানক্ষেতের মধ্যে বিচরণ করতে করতেই এসব লিখেছিলেন। নওগাঁর পাতিস্বর আর মালদহ ঘোরার সময়ে তিনি বাগান অবলোকন করেন এবং বরেন্দ্রতে ঘোরার সময়ে (অঘ্রাণে) তিনি ধানক্ষেত দেখেন। সেই সব আমগাছে এবার বোল থেকে মটরের দানা আকারের আমের গুটি বেরিয়ে পড়েছে। তাই চাষীর মুখে এত হাসি। যা আগে অনেকদিন দেখা যায়নি। মনে হবে রবি ঠাকুর এবারও আম চাষী আর ধান চাষীদের মুখে হাসি তুলে দিয়েছেন। সেই সব আম বাগানে বছরের কোন সময়েই সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। সেই সব আম বাগানে এবার মুকুলের সমারোহ। এসব গাছের পরিমাণ ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। জমির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার হেক্টরের কাছাকাছি। কারণ, কয়েক বছরে জেলার পুরো বরেন্দ্র ও দিয়াড় অঞ্চলে আমগাছের ও বাগানের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। বিশেষ করে দিয়াড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলের যেসব জমিতে ফসলের দেখা নেই, আবার ফসল হলেও ফলন নেই, কৃষক সেসব জমিতে কয়েক বছরে আমের গাছ লাগিয়ে দারুণভাবে উপকৃত হয়েছেন। মটর দানার আম যেন ঝরে না পড়ে তার জন্য কৃষক এখন বাগানমুখী হয়ে পড়েছেন। পরিচর্যা করছে বড় বড় ও ছোট ছোট আমগাছের। আম প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মে। তবে আমগাছের জন্য মাটি গভীর হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ২-৬ মিটার গভীরতা যুক্ত মাটিতে আম চাষ ভাল হয়ে থাকে। আমগাছের জন্য মাটি কিছুটা অম্লীয় হওয়া প্রয়োজন। যা এই অঞ্চলের মাটিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। আমের জন্য মাটির অম্লতা বা পিএইচ মান ২.৫-৭.০ সর্বোত্তম। স্থান নির্বাচনে রয়েছে বড় ধরনের মুন্সিয়ানা। আম বাগান স্থাপনের জন্য উঁচু ও সুনিষ্কাশিত জমি খুবই উপযোগী। সেচের সুবিধার বিষয়েও নজর দিতে হবে। পুরো শিবগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট ও নাচোলে বিদ্যমান। বাজার ও রাস্তার পাশে বাগান হলে বহু ধরনের সুবিধা প্রয়োজন। রাস্তার পাশে জমি হলে পরিবহন সুবিধা অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এছাড়া জমির মূল্য কম হওয়ায় একেবারে বাঞ্ছনীয়। শ্রমিক সহজ লভ্যতার বিষয়টিও মাথায় রেখে বাগানে স্থান নির্বাচন আবশ্যকীয়। যা এসবের সব কিছুই রয়েছে। বাগানের আকারে আমের চাষ করতে হলে নির্ধারিত জমি চাষ ও মই দিয়ে সমতল করতে হবে। জমিতে কোন ধরনের শক্ত জিনিসের অবস্থান থাকবে না। গাছের গুঁড়ি থাকলে উঠিয়ে ফেলতে হবে। জমি কর্ষণ করা থাকলে আমগাছের শিকড় বৃদ্ধিতে বড় ধরনের সুবিধা ও খাদ্য সংগ্রহে বড় ধরনের সহজ লভ্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। আমগাছ লাগানোর ব্যাপারেও সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাগানে আমগাছ ত্রিভুজাকার, বর্গাকার, আয়তাকার, ষড়ভুজাকার পদ্ধতিতে রোপণ করলে গাছ বড় হলেও সমস্যার সৃষ্টি করবে না। পাশাপাশি জাত নির্বাচনেও বড় ধরনের দৃষ্টি দিতে হবে। বিদেশের বাজারে রঙিন ও হাল্কা মিষ্টি জাতের প্রচুর চাহিদা বিদেশের বাজারের কথা চিন্তা করে এসব জাতের আমের গাছ লাগাতে হবে। এসব জাত নিয়মিত ফল দেয় কিনা, আকার আকৃতি, আশ্ব ও রসের পরিমাণ, মিষ্টতা, শতকরা ভক্ষণযোগ্যতা, সংরক্ষণ যোগ্যতা প্রভৃতি বিষয় মাথায় রেখে বাগান সম্প্রসারিত করতে হবে। চারা নির্বাচনেও লক্ষ্য রাখা একান্ত প্রয়োজন। সুস্থ, সবল ও রোগ-পোকার আক্রমণ মুক্ত চারা নির্বাচন করলেই উত্তম ফলন আশা করা যায়। ২-৩ বছরের বয়সী ভিনিয়ার বা ক্রেফট কলমের চারা লাগানো উত্তম। বীজের চারাতে মাতৃত্বগুণ বজায় থাকে না বলে এসব বর্জন করে চারা সংগ্রহ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব ও হর্টিকালচার সেন্টারে চারা সংগ্রহ করা ভালা। তবে শীতকালে চারা না লাগিয়ে বর্ষা মৌসুম অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় বা ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করা উত্তম বলে মনে করেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। আমগাছ সাধারণত ১২ মিটার বা ৪০ ফুট দূরত্বে লাগাতে হবে। দূরত্বে গাছ ৭০-৮০ বছর অন্য গাছের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে না। তবে ইদানীং ১০ মিটার দূরত্বে গাছ লাগানোর প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে খাটো জাতের আমগাছ ৬-৮ মিটার দূরত্বে লাগালেও ক্ষতি নেই। আমের চারা গাছ রোপণের পর জীবন ধারণ, সুষ্ঠু বর্ধন ও সুষম ফলদানের জন্য উপযুক্ত পরিচর্যা একান্ত প্রয়োজন। লাগানোর পর পরই গাছে নিয়মিত পানি দেয়া আবশ্যক। তবে বর্ষাকালে পানি তেমন না দিলেও চলবে। তবে গাছের গোড়ায় পানি জমে যাতে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা গাছের গোড়ায় আগাছা নিধনেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তবে নিয়মিত সার দিলে গাছের বাড়ন্ত অবস্থা অব্যাহত থাকবে। চারা গাছের গোড়ার কাঠামো ঠিক ও সোজা রাখার জন্য কিছুটা প্রয়োজনীয় ডাল ছাঁটাই করা উচিত। চারা গাছের এনথ্রাকনোজ আগামরা, অঙ্গজ বিকৃতি ও মুকুল বিকৃতি রোগ দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় জরুরীভাবে তা দমন করতে হবে। বিশেষ করে পাতা কাটা, হপার আক্রমণ দেখা দিলে দমনের ব্যবস্থা নিলে ভাল হয়। কলমের গাছে লাগানোর পরবর্তী বছর থেকেই মুকুল বা ফল আসতে পারে। তবে ছোট গাছে মুকুল ও ফল ভেঙ্গে ফেলা আবশ্যক। কারণ, মুকুল থাকলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। পাশাপাশি গাছ দুর্বৃত্ত হয়ে যেতে পারে। গাছের বয়স ৩-৪ বছর না হলে ফুল, ফল ধরতে দেয়া একেবারে উচিত নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের প্রধান উপপরিচালক, কৃষি বিজ্ঞানী ড. সাইদ জানান এসব পদ্ধতি মেনে না চললে নতুন বাগান তৈরি করতে বড় ধরনের অসুবিধা হবে। তবে প্রতি বছর আম উৎপাদনের জন্য কিছু করণীয় আছে। নিয়মিত ফলদানকারী জাত প্রতি বছর ফল দিয়ে থাকে। এসব জাতের চাষাবাদ যে স চাষী করে থাকে তারা প্রতিবছর ফল পেয়ে থাকে। যা এখন প্রচুর পরিমাণে আবাদ হচ্ছে। এছাড়া গাছে ফল আহরণের পর পরই জৈব সার ও পরিমাণমতো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। দু-এক বছর অন্তর সবুজ সারের চাষ করলে বাগান ভাল থাকবে। খরাকালীন অবস্থায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। গাছে যে বছর প্রচুর মুকুল আসবে তার এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ ছেটে দিলে পরের বছর সেই অংশে মুকুল ও ফল আসবে। তবেই প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ আমের ফলন বৃদ্ধি পাবে। এবার এখন পর্যন্ত আমের মুকুলে কোন ধরনের রোগ ব্যাধির আক্রমণ হয়নি। সাধারণত পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ হয়ে থাকে। এ রোগের জীবাণু আমের মুকুল আক্রমণ করে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। আমাদের দেশে এই রোগের আক্রমণ প্রতিবছর হয় না। কোন কোন বছর অনুকূল আবহাওয়া না থাকলে এই রোগের আক্রমণ হয় না। এ বছর এই রোগের কোন ধরনের আক্রমণ ছিল না। ফলে চাষীরা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছে। এক ধরনের ছত্রাক থেকে এই রোগের সংক্রামক হয়ে থাকে। মুকুল থেকে মটরের দানার মতো আম বেরিয়ে পড়ায় এবার আর মুকুল আক্রান্ত হয়নি। এই রোগ অল্প কিছু গাছে দেখা দিলেও মোকাবেলা করে তা অপসারণ করা হয়। আগামরা রোগ সব এলাকায় দেখা যায়। আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে এবারও। সব বয়সের গাছে এই রোগ আক্রমণ করে থাকে। পুষ্টিজনিত এই রোগ আক্রমণ করে থাকে গাছে। রোগের আক্রমণে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। তবে একটি রোগ বিকৃতি হতে পারে গাছের। তিন দশক পূর্বেও রোগটি আমাদের দেশে ছিল না। ভারতের কোন কোন জাতে ৩টি মারাত্মক সমস্যারূপে চিহ্নিত। আক্রমণের স্থান অনুযায়ী বিকৃতি দুই প্রকারের। যথা মুকুলের বিকৃতি ও দৈহিক বিকৃতি। এবার মুকুল বিকৃতির সময় পেরিয়ে গেছে। দৈহিক বিকৃতি সাধারণত চারা গাছ ও ছোট গাছে দেখা যায়। আমে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্র রোগরাল (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম) অথবা বাভিষ্টিন প্রতি লিটার পানিতে এক গ্রাম হারে ঢেলে দিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করে গাছ রোগমুক্ত করা যায়। যেহেতু আমটি সরকারী অনুমোদন পেয়েছে সেহেতু চাষী থেকে শুরু করে কৃষি বিজ্ঞানীরা রাতদিন সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছেন। আম গাছ লাগানোর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত বিভিন্ন পোকার আক্রমণ গাছে দেখা দিতে পারে। সুতরাং আমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সঠিক সময়ে পোকা দমন অপরিহার্য। আমের প্রধান প্রধান ক্ষতিকারক পোকা পরিচিতি ও তাদের ক্ষতির ধরন এবং দমন বিষয়ে পরামর্শের জন্য হটিকালকালচার, কৃষি সম্প্রসারণ ও আম গবেষণা তত্ত্ব অফিসের বিজ্ঞানীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের করার পরামর্শ আম চাষীদের কাছে। এখানে নানান জাতের আম রয়েছে। এর পরিপক্বতার ও সময় আম চাষীরা ভাল বুঝে থাকে। পাকা আম কখন পাড়তে হবে তা আম চাষীদের হাতে ছেড়ে দিলে সব চেয়ে বেশি ভাল হবে। কারণ ইতোমধ্যেই ‘খিরশাপাত’ যেমন জিও অনুমোদন পেয়েছে। তেমন চেষ্টা চলছে আরো দুটি জাত নিয়ে এর একটি ল্যাড়া, অপরটি আশ্বিনা। পরের অর্থাৎ আশ্বিনা জিও পেলে কৃষকরা আরও বেশি উপকৃত হবে। লেখক : সাংবাদিক
×