ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জল্পনা তুঙ্গে

সমঝোতা হলে সংসদে যাবে বিএনপি

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ৪ এপ্রিল ২০১৯

সমঝোতা হলে সংসদে যাবে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত গণফোরামের দুজন শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার পর বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় জনের বিষয়ে কী হয় তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন দলের নেতারা। সমঝোতা হলে বিএনপিও সংসদে যোগ দেবে। সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির দলীয় ফোরামে বেশ ক’বার সংসদে যোগ দেয়া না দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। দলের বেশিরভাগ নেতা সংসদে যোগ না দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। আর দল থেকে নির্বাচিত ছয় জনসহ কিছু নেতা সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তবে তারা এও বলেছেন দলীয় হাইকমান্ড চাইলেই কেবল তারা সংসদে যোগ দেবেন। এমন পরিস্থিতিতে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনতি হতে থাকলে তাঁর প্যারোলে মুক্তির বিষয়টিও আলোচনায় আসে। ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নতুন গতি পায়। আর তাঁকে প্যারোলে মুক্ত করতে হলে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ৬ জনকে সংসদে যোগ দেয়াসহ বিভিন্ন শর্ত মানার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। ২ এপ্রিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত গণফোরাম নেতা মোকাব্বির খান শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেন। এর আগে ৭ মার্চ মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদে যোগ দেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হয়ে এ দুই জন সংসদে যোগদানের পর বিএনপির ছয় জনের যোগদানের বিষয়টি নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা পেয়ে দেশে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁর ক’জন অনুসারী দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত ৬ জনকে সর্বক্ষণিকভাবে নজরদারিতে রাখছেন। তারা কখন কোথায় যান, কি করেন, কার সঙ্গে কথা বলেন তার খোঁজখবরও রাখেন। আর এ বিষয় আঁচ করতে পেরে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় জনও অস্বস্তিতে রয়েছেন। তবে দলীয় হাইকমান্ড শেষ পর্যন্ত কি নির্দেশনা দেয় তার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। জানা যায়, খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান চান না বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় জন সংসদে যোগদান করুন। তবে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সামনে চলে আসায় এ ইস্যুতে তার অবস্থানও কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় জন যাতে সংসদে যোগ দেয় সে জন্য বিদেশীদেরও চাপ রয়েছে। এ ছাড়া বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও চান তারা সংসদে গিয়ে দলের পক্ষে কথা বলুন। এ পরিস্থিতিতে এখন হোক আর পরে হোক একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরুর পর থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে। আর এ সময়ের মধ্যে সংসদে না গেলে তাদের আসনগুলো শূন্য হবে। তাই শেষ পর্যন্ত বিএনপিও সংসদে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরও ক’টি বৈঠকে জোট থেকে নির্বাচিত কেউ সংসদে যাবে না বলে জানানো হয়। কিন্তু তারপরও গণফোরামের দুই জন সংসদে যোগ দেন। তারা দু’জনই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেই সংসদে যোগ দিয়েছেন বলে জানান। কিন্তু ড. কামাল হোসেন এ বিষয়ে জোরালো কোন প্রতিবাদ করেননি। এ কারণে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি বিএনপির একাধিক নেতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন ও ড. কামাল হোসেনসহ এ জোটের নেতাদের কর্মকা- নিয়ে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেন। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর ওই দিন রাতেই বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচন দাবি করে। এরপর পুনর্নির্বাচনের দাবিতে দুর্বার আন্দোলনের কথা বললেও এখন পর্যন্ত তেমন কোন আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে পারেনি। তবে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে নির্বাচন কমিশনে জোটগতভাবে আবেদন ও গণশুনানিসহ বেশ কিছু কর্মসূচী পালন করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সম্প্রতি এ ইস্যুতে একটি মানববন্ধন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিয়েও পরে জোটের পক্ষ থেকে তা স্থগিত করা হয়। বিএনপির ইচ্ছেতেই এ কর্মসূচী স্থগিতের কথা জানা যায়। এতে মনে হয় শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংসদে যাওয়ার পথেই হাঁটছে। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ২৯ নবেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরও বিএনপি সংসদে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে এক পর্যায়ে তারা সংসদে গিয়ে সরকারের ভুলত্রুটির প্রতিবাদ করার পাশাপাশি দলের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে সে সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হন। তাই এবারও বিএনপি সংসদে না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা থেকে দলটি অনেক পিছিয়ে পড়বে। যা দেশ-বিদেশে বিএনপিকে নতুন করে চরম সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বিএনপি এখন সংসদে যাওয়ার বিষয়ে আগের চেয়ে নমনীয় বলে জানা গেছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ছয় আসন পেলেও সংসদে গিয়ে দলের পক্ষে ভূমিকা রাখতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ, জাতীয় সংসদে কথা বলার ক্ষেত্রে সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা হয়না। বিএনপি ইচ্ছে করলে অধিবেশন চলাকালে প্রতিদিনই পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখতে পারেন এবং সরকারী দলের ভুলত্রুটি থাকলে এর প্রতিবাদে ওয়াক আউট করতে পারবেন। এতে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করারও সুযোগ পাবে তারা। আর দলের প্রতিনিধিরা সংসদে থাকলে রাজপথে কর্মসূচী পালনের ক্ষেত্রেও সুবিধা পাবে বিএনপি। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ছয় জন। নির্বাচিতরা হলেন, বগুড়া-৬ আসন থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বগুড়া-৪ আসন থেকে মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে মোঃ আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে মোঃ হারুন উর রশিদ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং বি বাড়িয়া-২ আসন থেকে আবদুস সাত্তার ভূইয়া। সংসদে যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও যাওয়ার পক্ষে থাকা নেতাদের যুক্তি হচ্ছে- দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন কারাবন্দী। আইনী প্রক্রিয়ায় তাকে কবে মুক্ত করা যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় সাজা থাকায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশে ফিরে আসবেন না। এ পরিস্থিতিতে সংসদে গিয়ে প্রতিদিন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে দলীয় অবস্থান তুলে ধরা যাবে। আর সংসদে না গেলে রাজপথে যেমন কোন কর্মসূচী করার সুযোগ পাওয়া যাবে না, তেমনি ৫ বছরের জন্য সংসদে যাওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হবে। এতে বিএনপির লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দল থেকে নির্বাচিত ছয় জনের সংসদে যাওয়ার বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সংসদে যাবে কি না সেটা দলীয় হাইকমান্ড বলতে পারবে। আমরাও জানতে পারব যদি দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়। এর বেশি আপাতত আর কিছু বলতে পারব না।
×