ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী নেই -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ১০:৪০, ৪ এপ্রিল ২০১৯

অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী নেই -স্বদেশ রায়

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কথা ঘুরেফিরে আসছে। কেউ কেউ বলছেন, দেশকে বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা করছে সরকার। কেউ বলছেন, দেশে রাজনীতি করার কোন পরিবেশ নেই। অনেকে বলছেন, রাজনীতি করতে গেলে সরকার প্রশাসন দিয়ে বাধা দেয় যার ফলে রাজনীতি করা যাচ্ছে না। মূলত যারা এই কথাগুলো বলছেন তারা বর্তমান বিশ্বের ও দেশের পরিবর্তনকে অস্বীকার করছেন। তারা মূলত ষাটের দশকের চিন্তা-চেতনাকে লালন করেই এমন কথা বলছেন। গ্লোবালাইজেশন, ইনফরমেশন টেকনোলজি ও এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন যে বাংলাদেশের অন্তত তিনটি প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনাকে অনেক বদলে দিয়েছে- এই বিষয়টি বিশ্লেষণ না করেই ঢালাওভাবে এমন কথাগুলো বলা হচ্ছে। ইনফরমেশন টেকনোলজির মাধ্যমে দেশের কমপক্ষে তিনটি প্রজন্ম গ্লোবালাইজেশনের ফলটা ভালভাবে বুঝতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে বিশ্বের নানান প্রান্তের পরিবর্তনও। পাশাপাশি এশিয়ার অর্থনীতির পরিবর্তনের ট্রেনে গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অবস্থান করায় সমাজে ও বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে এসেছে পরিবর্তন। দেশের আর্থিক উন্নয়নের ফলও মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন এনেছে। আর এই পরিবর্তন শুধু যে বাংলাদেশে এসেছে তা নয়, এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে এসেছে। যেমন এখন থেকে দশ বছর আগেও ভারতের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা দিল্লী, বোম্বে, পাঞ্জাব ও কলকাতায় উচ্চশিক্ষা নিতে পারলে খুশি হতো বা সেটাই তারা বড় মনে করত। অথচ গত দুই বছরের হিসাব ভিন্ন- ভারত থেকে শুধু অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিবছর এক লাখের ওপর ছাত্র উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছে। এখন থেকে দশ বছর আগেও নেপাল ছিল একটি শতভাগ ভারতের অর্থনৈতিক নির্ভর দেশ। এখন নেপালের তরুণরা চীনের দিকে ঝুঁকছে। তাদের সঙ্গে তারা অর্থনৈতিক যোগাযোগে নেমেছে। সেখান থেকে এশিয়ার নানান দেশে বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রতিদিন শত শত তরুণ পাড়ি জমাচ্ছে। এর মূল কারণ, এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে এটি ঘটেছে আরও বেশি। কারণ, নেপাল ও ভারতের থেকে সামাজিক প্রায় সব ইনডেক্সে বাংলাদেশ এগিয়ে। এ কারণে এখন অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক যে পরিবর্তন এসেছে তা আরও কত দ্রুত এগিয়ে নেয়া যায় সেটাই রাজনৈতিক দলগুলোর মূল চিন্তার বিষয় ও দর্শন হওয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশের এ মুহুর্তের দুর্ভাগ্য হলো, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মূল চিন্তার ভেতর এই দর্শন নেই। পরিবর্তিত পৃথিবীতে ও বিশেষ করে পরিবর্তিত এই এশিয়াতে বাংলাদেশকে আরও ভালভাবে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় তার একটা অর্থনৈতিক দর্শনভিত্তিক কর্মসূচী থাকার কথা ছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির। কারণ, ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মসূচীর পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) অর্থনৈতিক কর্মসূচী ছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে দেরিতে হলেও কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর ন্যাপ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এক হতে পেরেছিল। কারণ, তারাও অর্থনৈতিক কর্মসূচীতে বিশ্বাসী ছিল। ন্যাপ মোজাফফরের অস্তিত্ব ওইভাবে আর নেই। তারা ছোট অবস্থায় চৌদ্দ দলের অংশ। তাই স্বাভাবিকভাবে রাজপথে ছোট ছোট যে দলগুলো আছে তাদের ভেতর পরিবর্তিত বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচী দেবার কথা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির; তারা সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে একটি বিষয় একটু পরিষ্কার করা দরকার। আজকাল অনেকেই বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দল মনে করে। মনে করার কারণও আছে। যেহেতু তারা জনগণের ভোট পায়। তারপরেও যে অর্থে কোন দেশে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি ওই অর্থে কোন রাজনৈতিক দল নয়। এরা সামরিক শাসকের উত্তরাধিকার। সামরিক শাসকরা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করার পরে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য দেশে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি করে। এরা সেই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। এর থেকে বেশি কিছু নয়। এ কারণে এদের কাছ থেকে কখনই কোন রাজনৈতিক দর্শন আশা করা উচিত নয়। লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, বর্তমানের এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে দেশের জন্য জাতীয় পার্টি ও বিএনপির কোন অর্থনৈতিক কর্মসূচী নেই। এ নিয়ে কোন তর্ক করারও কোন সুযোগ নেই- কারণ, গত নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যে নির্বাচনী ইস্তেহার ঘোষণা করেছিল সেগুলো পড়লে সবাই দেখতে পাবেন। পরিবর্তিত এই দেশ ও পৃথিবীকে স্বীকার করে তাদের কোন বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচী নেই। এর বাইরে গণফোরামের মতো নামসর্বস্ব যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তারা হচ্ছে কিছু ব্যক্তির একটি রাজনৈতিক পরিচয় ধরে রাখার হাতিয়ার মাত্র। তাই তাদের কাছে দেশের জন্য কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী আশা করা যায় না। এই সব রাজনৈতিক দলের বিপরীতে আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা বার বার আওয়ামী লীগের এই ক্ষমতায় আসা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা তাদেরকে অবৈধ সরকারও বলছে। আর তাদের সহযোগী বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ বিরাজনীতিকরণের দিকে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কোন বিতর্কও নয়, আবার আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে লড়াই নয়; শুধু একটা প্রশ্ন সামনে আসে, আওয়ামী লীগ নিজে একটি রাজনৈতিক দল। তারা যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে এটা রাজনৈতিক দল বলেই জিয়া বা এরশাদের মতো কোন ব্যক্তি হিসেবে নয়। তাহলে কেন একটি রাজনৈতিক দল দেশকে বিরাজনীতিকরণ করতে যাবে? বিরাজনীতিকরণ করার অর্থই হলো তাদের নিজের শিকড় নিজে কাটা। কেন সেটা তারা করবে? আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ও শেখ হাসিনার মতো একজন দক্ষ নেতাকে এতটা বোকা মনে করা উচিত নয়। বরং যারা এ কথাগুলো বলছেন তাদের ভেবে দেখা উচিত, তাদের এত অভিযোগের পরেও কেন মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে? কেন তাদের কথায় কোন মানুষ সাড়া দিচ্ছে না? এর উত্তর কোন বিতর্ক না করে শুধু গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামের পুস্তিকাটি পড়লেই বুঝতে পারা যায়, তাদের দেয়া অর্থনৈতিক কর্মসূচী কতটা বাস্তবভিত্তিক এবং পরিবর্তিত পৃথিবীতে ভবিষ্যতমুখী। এখানেই আওয়ামী লীগের বর্তমানে ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার মূল ভিত্তিটি নিহিত। এটা আওয়ামী লীগের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ধারাবাহিকতাও। কারণ, ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে অর্থনৈতিক কর্মসূচী দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগের হাল ধরার পরে সময়োপযোগী অর্থনৈতিক কর্মসূচী দিয়েছেন। ’৯০-এ তিনি রক্ষণশীল অর্থনীতি থেকে সরে এসে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেন। এর পরে ২০০৯ থেকে এবারের নির্বাচন অবধি অর্থনৈতিক কর্মসূচীর দর্শন ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও আকার বৃদ্ধি করছেন। অর্থনীতির পণ্ডিতদের মতে সেটা শতভাগ নাও হতে পারে। তার পরও সত্য, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে যতটুকু যা অর্থনৈতিক কর্মসূচী আছে সেটা আওয়ামী লীগের আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। জনগণ তাকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি নতুন প্রজন্ম আরও বাস্তবমুখী, আরও ভবিষ্যতমুখী আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের সামনে আসে তখন স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগকে পিছু হটতে হবে। [email protected]
×