ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

দুই ফুটবল প্রতিভার ফেরা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ৩ এপ্রিল ২০১৯

দুই ফুটবল প্রতিভার ফেরা

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) আবাসিক ক্যাম্পে পুরনো মহিলা খেলোয়াড় সংখ্যা ছিল ৪০। সম্প্রতি তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ১৪ জন। সবমিলিয়ে ৫৪। নতুন ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনই হচ্ছে অনুর্ধ-১৫ বয়সী খেলোয়াড়। জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের ভাষায় ‘নিউকামার এ্যান্ড ফ্রেশ প্লেয়ার’। এদের নেয়ার কারণটা তিনি জনকণ্ঠকে ব্যাখ্যা করেন এভাবেÑ ‘আমাদের রানিং অ-১৫ যে দলটা আছে, ওভার এজের কারণে কদিন পরেই তারা আর এই দলের হয়ে খেলতে পারবে না। ফলে তখন দলে যেন খেলোয়াড় সঙ্কট না হয়, সেজন্য আর দেরি না করে, আগেভাগেই নতুন খেলোয়াড় এনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।’ এই ১২ জন এসেছে ঢাকা, কক্সবাজার, নীলফামারী, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ ও জামালপুর জেলা থেকে। বাকি দুজন একটু ব্যতিক্রম। তারা এর আগেও জাতীয় দলের জার্সি পড়ে খেলেছিল। তাও সেটা কয়েক বছর আগে। মজার ব্যাপারÑ দু’জনেই নরসিংদী থেকে এসেছে! দু’জনেরই নামের শেষে ‘আক্তার’ শব্দটি আছে! একজন লিপি, অন্যজন সাদিয়া। তাদের সম্পর্কে ছোটন বলেন, ‘লিপি-সাদিয়া দু’জনেই এর আগে আমার অধীনে জাতীয় দলে খেলেছে। দু’জনের মধ্যে লিপি অ-১৪, ১৬ ও সিনিয়র দলে খেলেছে। আর সাদিয়া অ-১৪ দলে খেলেছে। পরে ওরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পারফরম্যান্সের জন্য দল থেকে বাদ পড়ে। এর পরেও ওরা খেলার মধ্যেই ছিল। জেএফএ কাপ, যুব গেমস, কেএফসি ফুটবল, বঙ্গামাতা ফুটবল... এই প্রতিযোগিতাগুলোর দিকে আমার সবসময়ই দৃষ্টি ছিল। এই আসরগুলোতে যখনই যারা ভাল খেলেছে, তখনই তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ... সবকিছু নোটবুকে টুকে রেখেছি। পরে সময়মতো একে একে লিপি-সাদিয়াসহ যে কজনকে দরকার, ক্যাম্পে ডেকেছি। এ ব্যাপারে মহিলা ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ফলে যেকোন ও দ্রুততম সময়েই এখন যে কাউকেই ক্যাম্পে ডাকতে পারছি।’ তবে চরম পেশাদার কোচের মতোই লিপি-সাদিয়ার প্রতি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করেন ছোটন, ‘যাদের ডেকেছি, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কজন টিকবে, সেটাই হচ্ছে কথা। ক্যাম্পে পুরনো যারা আছে, তাদের ফিটনেস এখন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। নতুনরা স্বাভাবিকভাবেই পুরনোদের চেয়ে এ ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে। কাজেই হার্ড ট্রেনিং ও যোগ্যতা প্রমাণ করেই তাদের দলে জায়গা করে নিতে হবে। নয়তো বাদ পড়ে যাবে। এখানে কারুর ফাঁকি দেয়ার কোন অবকাশ নেই। লিপি-সাদিয়াদের বেলাতেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাদের আবারও সুযোগ দিয়েছি ঠিকই, তবে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করতে হবে তাদের।’ রবিবার, মার্চের শেষ দিবস। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। গা জুড়ানো মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। সকাল ৭টার মধ্যে গেলাম বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। আগামী এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বঙ্গমাতা অ-১৯ নারী আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে ৫৪ নারী ফুটবলারকে একসঙ্গে অনুশীলন করাচ্ছেন ছোটন। অনুশীলনের শেষ পর্যায় চলছে। একটু অপেক্ষা করতেই তা শেষ হলো। কোচের অনুমতি দিয়ে সাদিয়া-লিপির ফটোশুট করলাম। তারপর বাফুফে ভবনে ফিরে তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা। লিপিকে দেখলাম পাঁচ বছর পর। দুরন্ত গতি ও স্কিলের জন্য তার খেলা খুবই পছন্দ করতাম। দুটো ইন্টারভিউও করেছিলাম জনকণ্ঠের জন্য। প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। একটা ছাপা হয়েছিল ‘লিপির ভাগ্যলিপি’ (২৯ মার্চ) এবং আরেকটা ‘পরিশ্রমের বিকল্প নেই ॥ লিপি’ শিরোনামে (১১ সেপ্টেম্বর)। শেষের ইন্টারভিউতে লিপির একটা কথা শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম, যা এখনও ভুলতে পারিনি, ‘কষ্ট না করলে মিষ্টি পাওয়া যাবে না’! সাদিয়াকে সর্বশেষ দেখেছিলাম কমলাপুর স্টেডিয়ামে, যুব গেমস ফুটবলের ফাইনালে। তারিখটা ছিল ১৪ মার্চ, ২০১৮। সেদিন তার পায়ের মুগ্ধ করা কারুকাজ দেখে মনে হয়েছিল এই মেয়ের জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র (অথচ তখনও জানতাম না তার দুই বছর আগেই জাতীয় দলে খেলেছিল সে!)। নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুরের চলনা গ্রামের মেয়ে চতুর্দশী সাদিয়া। জন্ম ২০০৪ সালের ২০ নভেম্বর। তার ফুটবলে আসার গল্পটা এরকম : চলনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০১২ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল দিয়ে শুরু। প্রথম কোচ মোহাম্মদ রাজ্জাক। পরের ধাপে নরসিংদী মহিলা জেলা ফুটবল দলে খেলা। এ উপলক্ষে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে খেলতে আসা। সেখানে তার খেলা দেখে বাফুফে তাকে ক্যাম্পে ডাকে। এরপর ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যায় এএফসি অ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে। কোচ ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ওখানে লাল-সবুজ বাহিনী তৃতীয় হয় এবং ফেয়ার প্লে ট্রফি অর্জন করে। ওই আসরে সাদিয়া ১টা ম্যাচ খেলেছিল রাইট উইং পজিশনে। এরপর ২০১৬ সালে সাদিয়া তাজিকিস্তানে যায় আরেকটি ‘এফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ’ খেলতে। ওই আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। কোচ ছিলেন ছোটন। এরপর ২০১৭ সালে কমলাপুর স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের হয়ে ট্রায়াল দিতে এসে বাদ পড়ে সাদিয়া। জাতীয় দলের হয়ে খেলার ওখানেই আপাতত ইতি! তবে মাঠে নেমে ফুটবল খেলার ইতি হয়নি সাভার বিকেএসপির দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাদিয়ার। বিকেএসপির হয়ে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ভারতে গিয়ে ‘সুব্রত কাপ’ খেলে সে। প্রথমবার না পারলেও পরের দু’বারই তার দল শিরোপা জেতে। ‘দু’বারই ছিলাম দলের ক্যাপ্টেন।’ গর্বিত উচ্চারণ সাদিয়ার। এছাড়া সপ্তাহ দুয়েক আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিক ওয়ার্ল্ড গেমসে ফুটবল খেলে এসেছে বাংলাদেশ দলের হয়ে। ‘ওই আসরে এবারই বাংলাদেশ মহিলা দল প্রথম খেলে। ফলে রেজাল্ট তেমন ভাল হয়নি। আমরা সেকেন্ড রাউন্ডে প্লেট পর্বে বাদ পড়ি।’ এছাড়া ঢাকা বিভাগ দলের হয়ে বাংলাদেশ যুব গেমসেও খেলেছে সাদিয়া। নামে ঢাকা বিভাগ হলেও আদতে এটি ছিল মূলত টাঙ্গাইল দল! নরসিংদীর মেয়ে, অথচ খেলোয়াড় টাঙ্গাইল দলের! কিভাবে সম্ভব হলো এটা? সাদিয়ার স্মৃতিচারণ, ‘আসলে ওই সময় যুব গেমসে নরসিংদী থেকে নারী ফুটবল দল গঠন করা হয়নি। ফলে হতাশ হয়ে পড়ি। তখন বিকেএসপির এ্যাথলেটিক্স কোচ শহীদ স্যার জানান টাঙ্গাইল মহিলা ফুটবল দল ঢাকা বিভাগ হিসেবে গঠিত হবে, সেখানে খেলোয়াড় সঙ্কট আছে। তুমি খেলবে? সানন্দে রাজি হই। যোগাযোগ করে ট্রায়াল দিই আমিসহ বিকেএসপির মোট ছয়জন। সবাই চান্স পাই এবং সব ম্যাচই খেলি। ২০১৮ সালের মার্চে কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে মহিলা বিভাগে আমাদের দল স্বর্ণপদক জেতে। ফাইনালে আমরা ময়মনসিংহকে হারাই ৩-১ গোলে।’ ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘আগের মতোই জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চাই। এজন্য কঠোর পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করতে চাই।’ সাদিয়ার ভাষ্য। এবার আসা যাক লিপির প্রসঙ্গে। জাতীয় দলের হয়ে তার সর্বশেষ খেলা ২০১৫ সাফ ফুটবলে। সেবার পাকিস্তান গিয়ে ২টি ম্যাচ খেলেছিল লিপি। এরপর ২০১৭ সালে বাফুফে আবারও ডেকেছিল তাকে। তবে সেবার লিপিসহ ৯ ফুটবলার বাছাইয়ে বাদ পড়ে। ‘এরপর আবারও দু’বছর পর ডাক পেয়েছি। যে সুযোগ পেয়েছি, তা কাজে লাগাতে চাই।’ লিপির দৃঢ়কণ্ঠ। মাঝের চার বছরের ফুটবল-এক্টিভিটি কেমন ছিল লিপির? ‘জাতীয় দলের খেলাগুলো দেখতাম। আর এলাকায় অনুশীলন করতাম। এ সময় কেএফসি ফুটবলে বিজেএমসির হয়ে খেলে ২০১৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হই। জাতীয় দলে না থাকলেও এই চার বছর খেলার মধ্যেই ছিলাম। নরসিংদীতে প্র্যাকটিসের তেমন উন্নত সুযোগ-সুবিধা নেই, তারপরও একা একা যতটা পারি করেছি। মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে বিভিন্ন ‘খেপ’ খেলতাম।’ পেছনে ফিরে তাকায় লিপি। ক্যারিয়ারের শুরুতে স্ট্রাইকার পজিশনে খেললেও পরে পজিশন বদলে কখনও মিডফিল্ডার, কখনও রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলেছে লিপি। স্ট্রাইকার পজিশন তার পছন্দের হলেও জাতীয় দলে এখন এই পজিশনে সাবিনা, স্বপ্না, কৃষ্ণা, তহুরা, শামসুন্নাহাররা প্রতিষ্ঠিত। ‘এদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ওই পজিশনে খেলা সত্যিই অনেক কঠিন। মূল স্কোয়াডেই সুযোগ পাওয়া কঠিন, আর সেরা একাদশে তো আরও দূরের ব্যাপার। তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করব। দেশের জন্য কিছু করতে হলে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। সেই ইচ্ছা ও আত্মবিশ^াস আমার আছে।’ চার বছর আগের এবং পরের জাতীয় দলের পরিবেশ, খাবার, ট্রেনিং ... এসবের মধ্যে কোন পার্থক্য? ‘অনেক পার্থক্য। সবকিছুই আগের চেয়ে আরও অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে ট্রেনিং। এই কয়েক বছরে উন্নত ট্রেনিং না পাওয়ায় ফিটনেসে ওদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। ওদের সমপর্যায়ে আসতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’ লিপির উপলব্ধি। বাদ পড়ার পরের সময়টা কেমন ছিল? ‘অনেক হতাশার ছিল। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছি বলে প্রতিবেশীদের অনেকেই ব্যঙ্গ করত। যখন টিভিতে দেখতাম বা পেপারে পড়তাম জাতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে, সুনাম কুড়াচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা দিচ্ছেন, টাকা-পয়সা পুরস্কার পাচ্ছে ... তখন ওদের জন্য যেমন গর্ববোধ করতাম, তেমনি অনেক আফসোসও লাগত। মনে হতো, আমিও তো ওদের সঙ্গে থাকতে পারতাম আর এগুলোর অংশীদার হতে পারতাম!’ ১৯ বছর বয়সী লিপি এখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছে নরসিংদীর অক্সফোর্ড কলেজে। একবার প্ল্যান অনুর্ধ-১৫ বালিকা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনালে এক গোলসহ মোট পাঁচ গোল করেছিল লিপি। ৫ ভাই, ৪ বোন লিপিরা। রেলের চাকুরে বাবা আশরাফ আলী। গৃহিণী মা জাহানারা বেগম। নরসিংদীর রায়পুরার মধ্যনগর নিবাসী লিপি। ২০১১ সালে ফুটবলে হাতেখড়ি। বঙ্গমাতা ও আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় সে। উদ্ভাসিত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সবার নজর কাড়ে। এরপর আর পিছু ফিরে তাকায়নি। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসির টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিল লিপি। আট দেশের অংশগ্রহণে সে-ই ছিল সর্বকনিষ্ঠা অধিনায়ক। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এএফসি অ-১৬ মহিলা ফুটবলের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ দলের অধিনায়কও হয়েছিল সে। যার প্রিয় ফুটবল দেশ আর্জেন্টিনা, প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি, সেই লিপির ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘যদি সুযোগ পাই, তাহলে অ-১৯, ২৩ এবং সিনিয়র দলে খেলতে চাই। এজন্য কিছু পেতে গেলে কষ্ট করতেই হবে।’ সাদিয়াকে নিয়ে জনকণ্ঠের কাছে আবেগের ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন কামরুন্নাহার খান মুন্নী। টাঙ্গাইল জেলা মহিলা ও অ-১৪ বালিকা ফুটবল দলের ম্যানেজার। উত্তরণ শিশু শিক্ষালয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ভীষণ ইচ্ছে ছিল ফুটবলার হবার। হতে পারেননি। সেই অপূর্ণ ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে হয়েছেন ফুটবলার গড়ার কারিগর। তিনি বলেন, ‘২০১৮ যুব গেমস থেকেই সাদিয়াকে চিনি। ও নরসিংদীর হলেও যুব গেমসে টাঙ্গাইলের হয়ে খেলেছিল। একটি ম্যাচে একাই সাত গোল করেছিল সে (বিপক্ষ : খুলনা বিভাগ)! সাদিয়ার সবচেয়ে বড় গুণÑতীক্ষè বুদ্ধি আছে, মাঠে নিজে খেলার পাশাপাশি সবাইকে নিয়ে খেলে। দলের প্রয়োজনে যেকোন পজিশনে খেলার বিরল গুণ আছে। তার গতি, টেকনিক, শূটিং নজরকাড়া। ওর আত্মবিশ^াস ও জয়ের খিদে অনেক বেশি। সতীর্থদের উজ্জীবিত করতে পারে। নেতৃত্বগুণ চমৎকার। ইনজুরির কারণে ও খেলতে না পারলে পুরো দলকেই দেখেছি স্তিমিত হয়ে পড়তে। খেলাটাকে অনেক ভালবাসে। ওর আচরণ অনেক মার্জিত ও পরিশীলিত। চরম দেশপ্রেমবোধ আছে, সততা আছে। রুচিশীল, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। অনেক মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।’ মুন্নী আরও যোগ করেন, ‘ওর এত গুণ, কাজেই প্রচ- আশাবাদী ছিলাম ও আবারও জাতীয় দলে ডাক পাবে। সেটা হওয়াতে ভীষণ আনন্দিত। আমার দৃঢ়বিশ^াসÑ আবারও সুযোগ পেয়ে সাদিয়া তার নিজের কোয়ালিটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে এবং অনেকদূর এগিয়ে যাবে। কদিন আগে রাতে ওর জাতীয় দলে ফেরা নিয়ে একটা স্বপ্নও দেখেছি! ও আমার মেয়ের মতো। ও তো আমাকে ‘মা’ বলেই ডাকে! সাদিয়ার মা-বাবা তাদের মেয়ের ভার আমার হাতেই সঁপে দিয়েছেন।’ ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে একসঙ্গে খেলেছিল লিপি-সাদিয়া। তখন তাদের কোচ ছিলেন যিনি, সেই আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘লিপি-সাদিয়া দু’জনকেই তখন পরিপূর্ণ ফুটবলার মনে হয়েছিল। ওরা ছিল সহজাত প্রতিভাময়ী খেলোয়াড়। জানি না, কেন ওরা মাঝে এত বছর জাতীয় দলে খেলতে পারেনি। লিপিকে আমি ‘ম্যারাডোনা’ ডাকতাম! শ্রীলঙ্কায় গিয়ে ও ছবির মতো সুন্দর-দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলেছিল। আমিরাতে গিয়ে কদিন আগে সাদিয়া স্পেশাল অলিম্পিক ওয়ার্ল্ড গেমস ফুটবল খেলেছে বাংলাদেশের হয়ে। ওই দলের কোচ হিসেবে বলতে পারি, ওর খেলা ছিল দেখার মতো। বিশেষ করে একটি ম্যাচে (সেভেন সাইড ফুটবল) প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে শট মেরে ওর করা অসাধারণ গোলটি এখনও আমার চোখে ভাসে।’ রাজ্জাক আরও বলেন, ‘লিপি-সাদিয়ার মতো ফুটবলারদের যদি একটু পরিচর্যা করা যায়, তাহলে ওদের ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল। মালী হিসেবে যদি ফুলের যতœ সঠিকভাবে নেয়া যায়, তাহলে সেই ফুল সুবাস ছড়াবেই। আশা করি লিপি-সাদিয়া ফুটবলে তেমনই সুবাস ছড়াবে। ওরা দুজনেই লড়াকু। জাতীয় দলের ক্যাম্পে কামব্যাক করায় আমি খুবই খুশি। তবে মাঝখানে কেন যে ওরা দলে ছিল না, সেটা আমার কাছে এখনও রহস্য। তবে একবার যেহেতু ফিরতে পেরেছে, আশা করি সহজে আরও ওদের বাদ দেয়া যাবে না।’ গোলাম রায়হান বাপন। টাঙ্গাইল মহিলা ফুটবল দলের কোচ। তারই শিষ্যা সাদিয়া। কোচ হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে ঈর্ষণীয় সফলতা পেয়েছেন বাপন। যুব গেমসে কোচ হিসেবে ঢাকা বিভাগ মহিলা দলের হয়ে ১ বার, জাতীয় আন্তঃস্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবলে কোচ হিসেবে ৮ বার এবং জেএফএ কাপে ১ বার চ্যাম্পিয়ন। স্কুল ফুটবলে এবং বঙ্গমাতা ফুটবলে ১ বার তৃতীয় এবং জাতীয় নারী ফুটবলে দু’বার সেমিফাইনালিস্ট। সম্পর্কে তিনি জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ ছোটনের ছোট ভাই। সাদিয়া সম্পর্কে বাপন বলেন, ‘২০১৮ যুব গেমসে ও আমার ঢাকা বিভাগের হয়ে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে দারুণ খেলেছিল। খেলাটা খুব ভাল বোঝে। খেলে পুরো মাঠ জুড়ে। অফুরন্ত দম। আশাবাদী ছিলাম ও খুব শিগগিরই জাতীয় দলে ফিরবে। সেটা হওয়াতে খুব খুশি হয়েছি। দলে থাকতে হলে ওকে আরও পরিশ্রম করতে হবে, আরও ভাল খেলতে হবে।’
×