ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অশ্বিনকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক

প্রকাশিত: ১২:১৩, ৩ এপ্রিল ২০১৯

অশ্বিনকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক

চলমান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে মানকড় আউটের ফাঁদে ফেলে সমালোচনার মুখে ভারতীয় তারকা রবিচন্দ্রন আশ্বিন। জয়পুরে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ম্যাচে সেদিন ১৪ রানের জয় পায় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। ৪৭ বলে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ৭৯ রানের টর্নেডো ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন ক্রিস গেইল। তবে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান জস বাটলারকে ‘মানকড়’ (অস্ট্রেলীয় উচ্চারণে যেটি মানকাড আউট বা মানকাডিং) আউটের ফাঁদে ফেলে সমালোচনার মুখে পড়েছেন পাঞ্জাব অধিনায়ক আশ্বিন। বোলিংয়ের সময়ু শেষ মুহূর্তে এ্যাকশন থামিয়ে ননস্ট্রাইক এন্ডে ক্রিজের বাইরে থাকা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান জস বাটলারের বেল ফেলে দেন তিনি। আশ্বিনকে ঘিরে ছি ছি পড়ে যায়। ১৩তম ওভারের শেষ বল। জয় থেকে ৭৭ রান দূরে রাজস্থান রয়্যালস। বল করতে যাচ্ছিলেন অশ্বিন। বল করতে গিয়ে দেখলেন, উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আছেন ননস্ট্রাইকে থাকা বাটলার। বল না করে স্টাম্প ভেঙে দিলেন। হতভম্ব বাটলারের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে আম্পায়ার–তৃতীয় আম্পায়ারের সহযোগিতা চাইলেন। আউট! এই ছিল ঘটনা। মানকাড় আউটের ক্ষেত্রে যে যুক্তি ব্যবহার করা হয়, সেটা হলো ব্যাটসম্যান আগে বের হয়ে রান নেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা নেন। কিন্তু অশ্বিন বল ছোড়ার ভঙ্গি করার সময়ও বাটলার ক্রিজে ছিলেন। অশ্বিন হঠাৎ করে থেমে যান, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর স্টাম্প ভেঙেছেন। সেদিকে বাটলারের পক্ষে নজর দেয়া সম্ভব হয়নি। বাটলার এ ক্ষেত্রে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে বোলারের ফলোধথ্রু অনুসরণ করছিলেন। ফলে, অবচেতনভাবে দাগ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তাঁর ব্যাট। এক্ষেত্রে আম্পায়ারের করার কিছু থাকে না। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে ও ভদ্রতার খেলা বলে ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে আনলে আলাদা কথা। কিন্তু অশ্বিন নিজেই তো অধিনায়ক! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা প্রথম ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচে। আশ্বিনের দেশেরই পূর্বসূরি ভিনু মানকড় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার বিল ব্রাউনকে এভাবে আউট করেছিলেন বলে তাঁর নামে এই আউটের নামকরণ। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ায় মানকড়ের এই ‘অখেলোয়াড়সুলভ’ আচরণের জন্য সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এবং এই ঘটনার পর থেকে এই ধরনের আউটকে রানআউটের চেয়ে বরং বলা হয় ‘মানকড় আউট’। সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফ বলেন, ‘এটা ক্রিকেটের আইনে পড়ে কিন্তু জস বাটলারকে অন্তত একবার সতর্ক করা উচিত ছিল অশ্বিনের। খুবই বিস্মিত হয়েছি! একবার আন্তর্জাতিক ম্যাচেও ওকে এটা করতে দেখেছি। মনে আছে সেবার শেবাগ সে আবেদন (আউটের) ফিরিয়ে নিয়েছিল।’ ইংল্যান্ডের ওয়ানডে অধিনায়ক ইয়ন মরগানের টুইট, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কী দেখছি! ছোটদের জন্য খুব বাজে উদাহরণ হয়ে থাকল। একসময় অশ্বিন এ নিয়ে অনুতাপ করবে।’ জেসন রয়ও বিস্ময় লুকাননি, ‘অশ্বিন, এটা খুবই বাজে আচরণ! দেখে খুবই হতাশ হয়েছি।’ তবে সবচেয়ে কড়া কথা শুনিয়েছেন শেন ওয়ার্ন, ‘অশ্বিনের লজ্জাকর ও কলঙ্কজনক কাজ নিয়ে শেষ কথা বলি! এই যেকোনোভাবে জেতার মানসিকতা বদলাতে হবে। ক্রিকেটের চেতনার সঙ্গে যায়, খেলাটা যেন দাগমুক্ত থাকে, এটাই বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। ছোট ছেলে ও মেয়েরা যারা ক্রিকেট খেলছে, তাদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।’ ভিনু মানকড়ের নাম থেকেই ক্রিকেটের ‘অদ্ভুত’ এই আউটের নামকরণ করা হয়েছিল। ঘটনাটা সেই ১৯৪৭ সালের। ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান বিলি ব্রাউনকে এভাবে আউট করে দেন ভারতীয় স্পিনার মানকড়। প্রথম ঘটনাই বেশ শোরগোল ফেলে দেয়। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যম ঘটনাটিকে ‘অখেলোয়াড়সুলভ’, ‘ক্রিকেটীয় চেতনাবিরোধী কাজ’ ইত্যাদি হিসেবে অভিহিত করেছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক, সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান কিন্তু এই আউটকে তখন সমর্থনই করেছিলেন। ‘মানকড়’ আউট নিয়ে বিতর্কটা সত্যি সত্যিই নিরন্তর। ক্রিকেট আইনের ৪৭.১৫ ধারায় বলা আছে, ‘কোন বোলার যদি বোলিং শুরু করার সময় দেখতে পায় নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, তাহলে বোলিং শেষ না করেই নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে আউট করার জন্য সে প্রান্তের স্টাম্প ভেঙে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ডেলিভারিটি ওভারের একটি বল হিসেবে গণ্য করা হবে না। কিন্তু ব্যাটসম্যানকে আউট করতে যদি বোলার ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা ডেড বল হিসেবে ধরা হবে।’ এই নিয়মের পক্ষে যুক্তিটা হলো, এই আইন না থাকলে বোলার দৌড় শুরু করলে নন স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যান তো আগেই অনেকটা এগিয়ে গিয়ে রান পুরো করার অন্যায় সুবিধা পাবে। কিন্তু মানকড় আউট নিয়ে বিতর্ক এ জন্যই হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যাটসম্যানের অসতর্কতার কারণেই আউটটি হয়েছে, অন্যায় সুবিধা নিতে চাওয়ার জন্য নয়। ক্রিকেট যেহেতু শুধু একটি খেলা নয়, খেলার চেয়েও বেশি কিছু, স্বাভাবিকভাবেই অনেকে এর বিপক্ষে। অনেকে তো ব্যাপারটিকে ‘বিব্রতকর’ ‘লজ্জাজনক’ ইত্যাদি বিশেষণেও অভিহিত করেছেন। সাবেক অস্ট্রেলিয়ার কোচ ড্যারেল লেম্যান, সাবেক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার টম মুডি থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে অধিনায়ক ইয়ন মরগান, ইংলিশ ক্রিকেটার জেমস অ্যান্ডারসন সবাই এটির বিরুদ্ধে। সোচ্চার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সবশেষ মানকাডিংয়ের শিকার হওয়া ইংলিশ ব্যাটসম্যান জশ বাটলারও।
×