ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীন বাংলার সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ॥ ৩ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১১:১১, ৩ এপ্রিল ২০১৯

স্বাধীন বাংলার সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ॥ ৩ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। এইদিন দেশ-বিদেশের পত্রিকায় গণহত্যার খবর, বাঙালী নিধন, পূর্ব বাংলা স্বাধীন এ জাতীয় শিরোনামে বিদেশী পত্রিকাগুলো পাক-বাহিনীর নির্মমতার খবর নিয়মিত প্রকাশ করে। সারা বিশ্বের বেতার ও টেলিভিশনে তা প্রচার হতে থাকে। খবরগুলো বিশ্ব বিবেককে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। তারা শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালীদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। কিন্তু অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ বিদেশী কোন পত্রিকা হাতে না পাওয়ায় সীমিতসংখ্যক বেতার বিশেষ করে কলকাতার আকাশবাণী এবং বিবিসির খবর রাতে কোন গোপন স্থানে একত্রে বসে শব্দ কমিয়ে শুনতেন প্রতিদিন আর তাতেই তারা উৎসাহিত হতেন। পাকবাহিনীর নির্মমতায় অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত নর-নারী শিশু দেশত্যাগ করে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। কোটি মানুষের দেশত্যাগের ছবি বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে তা সারা বিশ্বের মানুষের চিত্তকে আলেড়িত করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের নির্মমতা দেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দেশত্যাগী এক কোটি বাঙালীর জন্য পশ্চিম বাংলাজুড়ে অসংখ্য রিফিউজি ক্যাম্প গড়ে তুলে শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে এগিয়ে আসেন। এই শরণার্থী শিবিরগুলোর সচিত্র বিবরণও বিদেশী পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হতে থাকে। একাত্তরের এই দিনে সিলেটের শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল মুক্তিবাহিনীর চুয়াডাঙ্গার সদর দফতরে আসেন। তারা দৃঢ় মনোবলে উদীপ্ত যুদ্ধরত মুক্তিসেনা ও আহত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী লে. আতাউল্লাহ শাহসহ পাকিস্তানীদের কাছ থেকে দখলকৃত যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ির ছবি টেলিভিশন ক্যামেরায় ধারণ করেন এবং মেজর এমএ ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। চুয়াডাঙ্গায় পাকবাহিনী মেশিনগানের গুলি ছাড়া নাপাম বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে আক্রমণ করে। এ হামলায় বেশকিছু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় ও বহু লোক গুরুতরভাবে আহত হয়। চুয়াডাঙ্গাতে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির জন্ম হয়। জন্মলগ্নে সোসাইটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এমপি ড. আসহাবুল হক জোয়ার্দার। মেজর এমটি হোসেন ঠাকুরগাঁও স্থানীয় ডাকবাংলোতে যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত তাঁর অফিস স্থাপন করেন এবং অধীনস্ত জেসিও এনসিওদের দায়িত্ব বণ্টন করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নতুন মাত্রা যোগ হয়। এলাকার যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ে উর্দুতে লিখা একটি চিঠি ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে এদিন সবচেয়ে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে। অবাঙালী জনৈক লোকের হাতে প্রাপ্ত চিঠিতে সব গোপন তথ্য ছিল যা সৈয়দপুর সেনা নিবাসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফলে অবাঙালী হত্যা শুরু হয়। যা চলে পরবর্তী দুই দিন। এর পর থেকে ভীতিকর অবস্থা নেমে আসে গোটা শহরে। অবাঙালীদের বাড়িঘরের সব মালামাল এনে জমা করা হয় আদালত প্রাঙ্গণের কন্ট্রোল রুমে। পাকবাহিনী তিস্তা ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযাদ্ধাদের উপর প্রচ- গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে। এইদিন মধ্যরাতে রংপুরের প্রথম গণহত্যা ঘটে দখিগঞ্জ হত্যাকা-ের মাধ্যমে। এরপর ক্রমান্বয়ে বলারখাইল গণহত্যা, ঝাড়ুদার বিল ও পদ্মপুকুরের গণহত্যা, জয়রাম আনোয়ার মৌজার গণহত্যা, সাহেবগঞ্জের গণহত্যা, লাহিড়ীরহাটের গণহত্যা, ঘাঘটপাড়ের গণহত্যা, নিসবেতগঞ্জ গণহত্যা, দমদমা ব্রিজ গণহত্যা, জাফরগঞ্জ গণহত্যা প্রভৃতি নৃশংস হত্যাকা-ে রংপুরবাসী তাদের প্রিয়জনকে হারায়। পাকসেনাবাহিনী যশোরের মুক্তিবাহিনী অবস্থানরত এলাকাগুলোতে হঠাৎ করে ব্যাপকভাবে কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। শহরের দক্ষিণে অবাঙালী বসতির বিভিন্ন বাড়িতে পাকসেনারা ডিফেন্স নেয়। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর লে. কর্নেল সেন এবং মেজর চক্রবর্তীর সঙ্গে রাজশাহীতে ক্যাপ্টেন গিয়াস সামরিক সাহায্যের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘেরাও করে এবং ডাঃ মুরিদ আলী ও সেবক ব্রাদার এনামুল হককে গ্রেফতার করে। ঢাকাস্থ ইপিআর গেরিলা দল ডেমরা এবং যাত্রাবাড়ির পথে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বেশ ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয়। রংপুর শহরের শ্মশানঘাটে মধ্যরাতে ক’জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে চোখ, হাত বাধা অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। এটাই রংপুর শহরে পাকবাহিনী কর্তৃক প্রকাশ্য হত্যাকা-। রংপুর ইপিআরের দশম উইং-এর সহকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ আহমেদকে মুক্তিযোদ্ধা আকতারুজ্জামান ম-লের দলের কমান্ডিংয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল বাহিনী পাকসেনাদের ব্যবহার উপযোগী রামপুর রেলওয়ে সেতু (পুরানপাড়া রেলওয়ে সেতু) উড়িয়ে দেয়। গোড়ান-সাটিয়াচরায় পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী ৭২ এমএম আরআর ও ১২০ এমএম কামানের গোলা ও হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগানের বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ভেঙ্গে দেয়। এতে তেইশ-চব্বিশজন ইপিআরসহ তিরিশজন মুক্তিযাদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। সিলেটের দেওড়াছড়া চা বাগানের ৭০ জন শ্রমিককে পাকবাহিনী রেশন দেয়ার কথা বলে বাসে তুলে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানী প্রচারযন্ত্র কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য গণহত্যার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা এইদিন মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম,‘অপঃরড়হ ধমধরহংঃ সরংপৎবধহঃং ধঃ ঔরহলরৎধ’ অর্থাৎ ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।’ আর পাকিস্তান টেলিভিশন রাতে খবর প্রচার করে, ‘বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হস্তে নির্মূল করা হয়েছে।’ রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাত হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এই যুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্র শক্তি। সেদিনের আলাপে মুক্তিযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রসদ, শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান, বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি লাভ করেন। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠান সে বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবেলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা ছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×