ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সারওয়ার-ই-আলম

বিচারপতি মোর্শেদ ॥ শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৩ এপ্রিল ২০১৯

বিচারপতি মোর্শেদ ॥ শ্রদ্ধাঞ্জলি

ধীমান ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ প্রধান বিচারপতি হিসেবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নির্ভীক আপোসহীন বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এতদঞ্চলের ইতিহাসে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসার আসনে নিজেকে আসীন করেছেন। অভিজাত ব্যক্তিত্বের অধিকারী সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের জন্ম সম্ভ্রান্ত একটি বাঙালী মুসলিম পরিবারে। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকটায়, যে সময়টিতে এতদঞ্চলে ব্রিটিশ রাজবিরোধী আন্দোলনের মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক সে সময়ে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লিংকন্স ইন থেকে বিরল কৃতিত্বের সঙ্গে বার এ্যাট ল’ ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ তারও আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভাবনীয় কৃতিত্বের সঙ্গে পলিটিক্যাল ইকোনমিক্স বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সৈয়দ মোর্শেদ কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুখোড় বিতার্কিক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট, আইনজীবী, বিচারক, রাজনীতি বিশ্লেষক, কবি ও সাংবাদিক মহলে দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারী সৈয়দ মোর্শেদ বিশেষভাবে সমাদৃত। প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদকে অভিহিত করেছেন অত্যন্ত উচ্চমার্গের একজন স্নিগ্ধরুচির মানুষ হিসেবে যার সাংস্কৃতিক চেতনা, চারিত্রিক মহিমা, রসবোধ, দয়া, সহমর্মিতা, অন্যকে প্রশংসা করার উদারতা ও আভিজাত্য ছিল বিরল। আলোকিত ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এই মানুষটির প্রজ্ঞা ও আভিজাত্যের স্ফূরণ ছিল বহুমাত্রিক। বিচারপতি মোর্শেদ দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং চরম প্রতিকূলতার মাঝেও ন্যায়বিচারের আদর্শকে উচ্চে তুলে ধরতে পুনঃপুনঃ সচেষ্ট ছিলেন। কখনও কখনও শীর্ষ পর্যায় থেকে আপোসের নির্দেশ এলেও ন্যায়বিচারের সুমহান স্বার্থে তিনি তা প্রত্যাহার করতে কিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। বিচারপতি মোর্শেদ এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ বিচারক ছিলেন; যিনি বহু বছর ধরে নির্ভীকচিত্তে আইনের শাসনকে সুউচ্চে তুলে ধরেছেন এবং প্রচ- চাপের মধ্যে থেকেও কোনরূপ রক্তচক্ষুর প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে দ্বিধাহীন চিত্তে সুনিশ্চিত করেছেন সুবিচার। সহকর্মীদের কাছে বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন খুবই সজ্জন একজন মানুষ। প্রধান বিচারপতি হিসেবে মেয়াদ পূর্তির আগেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়াকালে সহকর্মীদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেনÑ আপনারা আমার এক সময়ের সুহৃদ সহযোদ্ধা। আপনাদের সকলকে জানাই আমি সশ্রদ্ধ সালাম। আইন পেশার দারুণ কর্মব্যস্ততার মাঝেও সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সামাজিক ও মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকা-ে এবং লেখালেখিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। জিন্নাহকে তির্যক সমালোচনা করে তাঁর লেখা ‘কিউ বাদিস কায়েদ-ই আযম’ ১৯৪২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দ্য স্টেটসম্যান’ ও ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘দ্য টেলিগ্রাফে’ মুদ্রিত হলে সুধী মহলে তা ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সৈয়দ মোর্শেদ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করে সম্ভাব্য শান্তির আকাক্সক্ষার নেহরু- মোর্শেদ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রাদায়িক সহিংসতা বন্ধ করে সম্ভাব্য শান্তির আকাক্সক্ষার নেহরু লিয়াকতের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, সৈয়দ মোর্শেদ ছিলেন সে শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার একজন অগ্রসেনানী। লেখক : গবেষক
×