ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

আর কত আবরার!

প্রকাশিত: ১১:০২, ৩ এপ্রিল ২০১৯

আর কত আবরার!

১৯ মার্চ মঙ্গলবার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়েন বিইউপির মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আবরার মেধাবী ছাত্রই নয়, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সে নিজেই এক সময় প্রাণঘাতী যন্ত্রদানব, পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা আর অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাজপথে নিজেকে শামিল করেছিল। বেপরোয়া চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার উন্মাদনার শিকার হয়ে সেই রাজপথেই তাকে মূল্যবান জীবনটা দিয়ে দিতে হলো। আর কতবার প্রতিবাদমুখর এবং প্রতিকারের উপায় চেয়ে রাজপথে নতুন প্রজন্মকে নেমে আসতে হবে? মাত্র সাত মাস আগের কথা। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বনানীতে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার ওপর যে দায়িত্বহীনতার অপবাদ চাপে সেটার আদৌ কোন নীতিনিষ্ঠতায় সুরাহা হয়েছিল কিনা সময়ই তার যথার্থ জবাব দিয়ে দিল। ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। সেবার গোটা দেশ আন্দোলন আর সড়ক অবরোধের মাধ্যমে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র চালকের গাফিলতি নয়, সড়ক পরিবহন আইনের তোয়াক্কা না করাসহ আরও অনেক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে পথ দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করা গেলেও সমস্যা যে তিমির সে তিমিরেই থেকে যাওয়াটা দৃশ্যমান হলো আবারও। যাত্রী এবং পথচারীর বিপন্ন অবস্থার আবর্তে পড়তে দুর্বৃত্ত চালকরাই শুধু নয়, সড়ক পরিবহনের হরেক রকম বিপত্তিকেও সামনে নিয়ে আসে। গত বছরের ২৯ জুলাই ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক প্রাণসংহারে ক্ষিপ্ত হয়ে সর্বপ্রথম রাস্তায় নেমে আসে তার সতীর্থ ও সহপাঠীরা। নিহত দুই ছাত্রছাত্রীর একেবারে কাছের সুহৃদরা এই জঘন্য হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সারা ঢাকা শহরকে উত্তপ্ত করে তোলে। শুধু তাই নয়, প্রতিকারের যথার্থ উপায় চিহ্নিত করে সারাদেশের উদ্দীপ্ত তারুণ্য সরগরম করে তোলে রাজপথ। তারুণ্যের বহ্নিশিখা টকবগ করে জ্বলে ওঠে। দেশের ভাবী প্রজন্ম তাদের জীবন গড়ার এমন পথপরিক্রমাকে নিরাপদ, বিধিসম্মত এবং সুপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার স্থায়ী সমাধানও চায়। সড়ক পরিবহনকে জনবান্ধব, আধুনিক এবং সময়ের উপযোগী করে তুলতে সব ধরনের কর্মপ্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তির উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার গতানুগতিক অবয়ব মুছে তাকে ঢেলে সাজানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়। টানা ২০ দিন সড়কে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা এই উদ্দীপ্ত তারুণ্য সারা দেশকে তাক লাগিয়ে দেয়। অন্যায় আর চলতে থাকা প্রাণঘাতী ঘটনাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যমাত্রায় ছাত্র আন্দোলন থেকে কঠিন অঙ্গীকারে নিজেদের প্রত্যয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। এমন অভিমতও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে উঠে আসে শুধুমাত্র অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে গর্হিত অন্যায়ের প্রতিবিধান করা কোনমতেই সম্ভব নয়, যদি না স্থায়ীভাবে কোন সমাধানের পথ নিশ্চিত করা যায়। এমন অবাঞ্ছিত আর ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিকারে স্থায়ী কোন বিধান একান্ত আবশ্যক। সঙ্গত কারণে আইনী এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতান্ত জরুরী। সেবার সারা বাংলা প্রত্যক্ষ করল আগামী প্রজন্ম অদ্ভুত এক অমিত সাহস আর দৃঢ় মনোবলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে তাদের অবস্থান জানান দেয়। শুধু তাই নয়, সড়কে উল্টো পথে গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে অদক্ষ চালক ছাড়াও মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহনসহ যাত্রী পারাপারে আইনগত বিধিকেও সুস্পষ্ট অভিব্যক্তিতে শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেও কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে। সময়ের এসব বলিষ্ঠ পথিক সেদিন যেভাবে সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটি-বিচ্যুতি শনাক্ত করেছিল তা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে তাদের অবিস্মরণীয় ভূমিকারও যথার্থ নিদর্শন। বৈধ কাগজপত্র, বেতন-ভাতা নির্ধারণ ছাড়া গাড়ি এবং চালকের যে বেপরোয়া অনিয়ম তাতে শুধু প্রচলিত আইনই বিঘিœত হচ্ছে না, তার চেয়েও বেশি অসহায়, নিরীহ মানুষের প্রাণ সংহারের মতো ঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। সে সব কার্যক্রমে উপস্থিতভাবে কিছু মেনে নেয়া হলেও যথার্থ সমাধান যে আজ অবধি নেয়া হয়নি, মেধাবী ছাত্র আবরার নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে সেটা আবারও প্রমাণ করল। চালক, যানবাহন এবং সড়ক নিয়ে পরিবহনের যে আইনকানুন নির্ধারণ করা আছে তাকে অমান্য করার যথাযথ কারণ কি কখনও স্পষ্ট হবে? নাকি মালিক, শ্রমিক, যাত্রী কিংবা পথচারী কেউই সে বিধিকে না মানার অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না। জেব্রা ক্রসিং কিংবা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পথচারী পারাপারের বিধি থাকলেও সচেতন-অসচেতন আবালবৃদ্ধবনিতা কেউই তাকে অনুসরণ করছে না। আবরার একজন সচেতন মেধাবী শিক্ষার্থী। সড়ক পরিবহন আইনকানুন সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিফহাল। সে কিন্তু জেব্রা ক্রসিং দিয়েই রাস্তা পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার জন্য বাসে উঠছিল। কিন্তু উন্মত্ত চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশৃন্য হয়ে পড়লে এই নিরীহ ছাত্রটি সেই উন্মাদনার শিকার হয়। সামনের গাড়িকে অতিক্রম করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কত মানুষের মূল্যবান জীবন যে মাত্রায় রক্তাক্ত স্রোতের ধারায় বলি হয়, তার হিসাব কে দেবে? দানব চালক তো প্রাণঘাতী ঘটনার অবতারণা করে পালিয়ে যায়। পেছন ফিরে তাকায়ও না তার অদক্ষতা আর নির্মমতায় কত মানুষের মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয়। এমন নিষ্ঠুর, অমানবিক কার্যক্রমকে শুধুমাত্র অপরাধ বিবেচনা করলে সত্যের অপলাপ হয়। সড়ক-মহাসড়কের সঙ্কেত চিহ্নের অব্যবস্থাপনা, উন্নত দেশগুলোর মতো সবুজ কিংবা লাল সঙ্কেত গাড়ি চলার গতি থামানো কিংবা চালিয়ে যাওয়া নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয়। বরং রাস্তায় কর্তব্যরত সার্জেন্ট কিংবা ট্রাফিক পুলিশ এই দায়িত্ব পালন করে হাতের ইশারায়। তা যেমন দৃষ্টিকটু, একইভাবে অনৈতিকও। গত বছরের আগস্ট মাসের সুসংহত এবং সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ট্রাফিক পুলিশও স্বাচ্ছন্দ্যে ছাত্রদের পাশে থেকেছে। সরকার প্রধানও শিক্ষার্থীদের এমন যৌক্তিক দাবির প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে মেনে নেয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন। ১৪ থেকে ২০ বছরের এই আধুনিক প্রজন্মের এমন অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সেও যেন এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা। এবারের আবরার হত্যায় উদ্ভূত বেসামাল অবস্থাকেও নিজেদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে নিতে তাদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারী ব্যবস্থাপনাও আন্দোলনরত ছাত্রদের অনুষঙ্গ হয়েছে। নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং ডিএমপি প্রধান আসাদুজ্জামান মিয়া বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের পেশকৃত দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। শুধু তাই নয়, এসব দাবি পূরণের প্রাসঙ্গিক সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দেন। দেশের ভাবী কর্ণধার এই সময়ের প্রজন্ম যদি যৌক্তিক ব্যবস্থাপনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়, তাহলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে কোন অপশক্তি কূটকৌশল প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হবে। সময়ে বাংলাদেশের উদ্দীপ্ত তারুণ্য যে চৈতন্যবোধে জেগে ওঠে সেটাই সম্ভাবনাময় আধুনিক বাংলাদেশ তৈরিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। তবে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যাত্রী ও পথচারীদের কিছু নিয়মনীতি মেনে চলা আইনী বিধান মোতাবেক আবশ্যকীয়। অদক্ষ কিংবা আনাড়ি চালক এমন কি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনই যে শুধু পথ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তা নয়। পথচারী ও যাত্রীদের পরিবহন বিধি অনুসরণ করে সড়ক-মহাসড়কের যাত্রাকে নিরাপদ ও সুস্থির করে তুলতে হবে। তাহলে প্রত্যেক মানুষ যদি নিজ দায়িত্বে তার প্রতিদিনের জীবনকে অশুভ সঙ্কেত এবং সঙ্কট থেকে বাঁচাতে না পারে সেখানে আইন, বিধি, রাষ্ট্র, সমাজ কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। লেখক : সাংবাদিক
×