ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ

রাজধানীর বহুতলে সাঁড়াশি অভিযান, নানা অনিয়ম

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩ এপ্রিল ২০১৯

রাজধানীর বহুতলে সাঁড়াশি অভিযান, নানা অনিয়ম

আজাদ সুলায়মান ॥ ফায়ার কোড না মেনে তৈরি করা ভবন চিহ্নিত করতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের যৌথ এ অভিযানের শুরুতেই ধরা পড়েছে অবিশ্বাস্য সব অনিয়ম। বিশেষ করে বহুতল ভবনের অবকাঠামো ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থায় কতটা অনিয়ম করা হয়েছে- সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযানের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার রাজধানীর অভিজাত গুলশান বনানী ও পুরান ঢাকায় বেশ কিছু বহুতল ভবন চরম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিন অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শতভাগ নিরাপদযোগ্য মাত্র একটি ভবনের সন্ধান পেয়েছে এই টিম। অভিযানের সময় বহুতল ভবন নির্মাণে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের সব শর্ত বা বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে কিনা- মূলত সেটাই খতিয়ে দেখা হয়। অভিযানের খবর পেয়ে কয়েকটি ভবনের মালিক মূল গেটে তালা মেরে সটকে পড়েন। এবারের অভিযানে আর রক্ষা নেই- এমন আশঙ্কায় অনেকেই বহুতল ভবন ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে মঙ্গলবার রাজধানীর কলাবাগান থানা সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্যত্র। এছাড়া বঙ্গবাজারে আগের দিন সোমবার চরম ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যানার টানিয়ে দেয়ায় এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানিয়েছেন, এভাবে পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটে সতর্ক নোটিস বা ব্যানার টানানো হবে। যাতে মানুষ সচেতন হতে পারে। সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে কয়েকটি ভবনের বেজমেন্ট, কারপার্কিং, জরুরী বহির্গমন সিঁড়িসহ বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করা হয়। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের বেশ কয়েকটি ভবন পরিদর্শন করে। এতে বেশির ভাগই ত্রুটি ধরা পড়ে। অর্থাৎ যথাযথ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না মেনে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো- প্রাসাদ ট্রেড সেন্টার নামে একটি সুরম্য অট্টালিকা গত বছর উদ্বোধন করা হয়েছে। এভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে দেখতে হয় এর অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলী ও উচ্চতা। অথচ এমন একট সদ্যনির্মিত ভবনেও আগুন প্রতিরোধে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু লোক দেখানো। কোনভাবেই তাকে কার্যকর হিসেবে মানতে নারাজ ফায়ার সার্ভিসের। এ সম্পর্কে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে বছরও হয়নি। অথচ এরই মধ্যে প্রতিটি ফ্লোরে গড়ে উঠেছে বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ইমার্জেন্সি এক্সিট বা জরুরী নির্গমনের সিঁড়ি মাত্র ৩০ ইঞ্চি চওড়া। সেই সিঁড়ি খুঁজে পেতে যে চিহ্ন বা সংকেত থাকার কথা, তাও নেই। এত বড় ভবনের এত ছোট নির্গমন সিঁড়ি নিয়ে আপত্তি করেছে ফায়ার সার্ভিস। ন্যূনতম দেড় মিটার চওড়া জরুরী নির্গমন সিঁড়ি থাকার কথা। ফায়ার ফাইটিংয়ের অনুকূলে কোন ব্যবস্থাই এই ভবনে এখনও করা হয়নি। অথচ ভবনটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতিটি তলায় রয়েছে লোক দেখানো ফায়ার হাইড্রেন্ট। বেজমেন্টে গিয়ে দেখা যায়, হাইড্রেন্ট পাইপের সঙ্গে কোন পাম্পের সংযোগ দেওয়া হয়নি। এখানকার প্রতিটি তলায় ঘুরে দেখা যায়, কোন তলাতেই হিট ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেক্টর লাগানো হয়নি। নেই ফায়ার এ্যালার্ম। আগামী এক মাসের মধ্যে ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঠিক করার নির্দেশ দেন তারা। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা তাদের এক মাস সময় দিয়েছি। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঠিক করে ভবনটি ব্যবহারের জন্য তাদের অনুরোধ করেছি। কারণ এটি এখনও নির্মাণাধীন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জরুরী ভিত্তিতে ভবনটিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট, স্প্রিংক্লার ব্যবস্থা, স্মোক ডিটেক্টর, হিট ডিটেক্টর, ফায়ার এ্যালার্ম জরুরী ভিত্তিতে স্থাপন করতে বলেছেন। ভবনটিতে আলাদা করে সাবস্টেশন ও জেনারেটরের সুইচ রুম তৈরির কথা বলা হয়। ইমার্জেন্সি এক্সিট লাইট, এক্সিট সাইন ও সার্বক্ষণিক সব সিঁড়ি ছাদ পর্যন্ত খোলা রাখতে বলেছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের নম্বর ভবনের সিঁড়িতে লাগিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একতলা বেশি করেছে এবিসি টাওয়ার ॥ এদিকে প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারের পাশের এবিসি হাউসেও অনিয়মের চিত্র ধরা পড়েছে। এই এভিনিউয়ের প্রথম অট্টালিকাসদৃশ এই ভবনটিতে সরেজমিন পরিদর্শনে ধরা পড়ে ১৩ তলা। কিন্তু রাজউকের রেকর্ডে দেখা যায়, এটির নক্সায় আছে ১২ তলার অনুমোদন। ১৩ তলায় রয়েছে ‘দ্য স্কাই রুম ডাইনিং’ নামে একটি রেস্তরাঁ। ছাদে ওঠার জন্য নেই কোন সিঁড়ি। লোহার তৈরি মই বেয়ে ছাদে ওঠানামা করতে হয়, যা চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে এবিসি রিয়েল এস্টেটের প্রধান প্রকৌশলী গোলাম মওলা খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, আমি এখানে সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। ভবনটি পুরনো। আমার জানা নেই এখানে কী কী সমস্যা আছে। যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে আমরা দ্রুত সেগুলোর সমাধান করব। যা মানার তার সবই মানা হবে। এ সময় পরিদর্শনকারী যৌথ দল এবিসি টাওয়ারের ১৩ তলার ‘দ্য স্কাই রুম ডাইনিং’ নামের রেস্তরাঁ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন রাজউকের জোন-৪-এর পরিচালক মামুন মিয়া। তিনি বলেছেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করায় রেস্তরাঁটি বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্রত সময়ের মধ্যে অবৈধ অংশ সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্সিট সিঁড়ি নেই টাওয়ার হেমলেটে ॥ একই এভিনিউয়ে অবস্থিত টাওয়ার হেমলেটেও ধরা পড়েছে অনিয়ম। ১৭ তলা বিশিষ্ট এ ভবনটিতে ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি খুঁজে পাননি রাজউকের কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে তারা দেখতে পান ভবনের বেজমেন্টও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে এলোমেলোভাবে গাড়ি পার্কিং করা রয়েছে। বেজমেন্টে বৈদ্যুতিক তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। অভিযান প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেনÑ আমরা এখন তথ্য সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে ভবনের ত্রুটিগুলো প্রকাশ করা হবে। যারা নিয়ম মানেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দায়ভার তো কিছু না কিছু আমাদের নিতেই হবে। আমাদের লোকবলও কম ছিল। মাত্র দুমাস আগে পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল মার্কেটসহ ১৭৩ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ॥ একই দিন সদরঘাট এলাকার ফায়ার সার্ভিস ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন সুপার মার্কেটসহ ৫৩ ভবনকে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। এছাড়া ১৭৩ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে সদরঘাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোস্তফা মোহসিনের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন সুপার মার্কেটকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ সংবলিত একটি ব্যানার টানিয়ে দেন। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা মোহসিন বলেন, এই ভবনটি ১৫ তলা সংবলিত একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এখানে ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আমরা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দুবার চিঠি দিয়েছি অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার জন্য- এরপরও তা মানা হয়নি। মানুষের জানমালের স্বার্থে আমরা ভবনটিকে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছি। মার্কেট কর্তৃপক্ষ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা করে ফায়ার সার্ভিসকে জানাবে। পরে ভিজিট করে সন্তুষ্ট সাপেক্ষে ব্যানার খুলে দেয়া হবে। ফায়ার কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, বাণিজ্যিক ভবনটিতে আগুন লাগলে জরুরী বহির্গমনের জন্য কোন সিঁড়ি নেই, ফায়ার এলার্ম নেই, বিদ্যুত গেলে জরুরী লাইটিংয়ের কোন ব্যবস্থা নেই, রাইজার পয়েন্ট নেই, বেজমেন্টে পানির রিজার্ভ ট্যাংকি নেই, পাপ্ম নেই, হাইড্রেন্ট পয়েন্ট নেই, এক্সটিংগুইশার ও হোস পাইপ নেই। ভবনটি একটি মানুষ মারার ফাঁদে তৈরি হয়েছে। এ ধরনের আরও বেশ কিছু ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোতেও অভিযান চালানো হবে। এর আগের দিন সোমবার পুরান ঢাকার অপর বিশাল মার্কেট বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকেও অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতারা এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছেন। মার্কেটের সামনে বিশাল ব্যানার দেখে অনেকেই ভেতরে প্রবেশ করে দ্বিধাবোধ করেন। সাধারণ জনগণকে এ বিষয়ে সতর্ক করতে ঘোষণাটি ব্যানার আকারে মার্কেটের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। ব্যানারে লেখা রয়েছে, অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। এ বিষয়ে মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেট দিয়ে সতর্কীকরণের এ কার্যক্রম শুরু করা হলো। আমাদের পরিচালিত জরিপে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত এবং এখনও ঝুঁকি নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি এমন সকল মার্কেট, আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সকল স্থাপনায় এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হবে। নিরাপদ বাড়িতে কলাবাগান থানা ॥ এদিকে নিরাপদ বোধ না করায় নতুন বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়েছে কলাবাগান থানা। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টারটি ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। নিজস্ব থানা ভবন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে আব্দুল মোমেন গ্রুপের এ ভবনে জনসাধারণকে সব ধরনের আইনী সেবা প্রদান করা হবে। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে অস্থায়ী ভবনে কলাবাগান থানার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া। এ সময় তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে কলাবাগান থানা ভবনটি ছিল জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। অপরাধ দমন ও ভাল নাগরিক সেবা দেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব থানা ভবন জরুরী। পুলিশের সেবা সবাই চাই কিন্তু পুলিশের অবকাঠামো ও জায়গা কেউ দিতে চাই না। উল্লেখ্য, ধানমণ্ডি থানা ভেঙ্গে ২০০৯ সালে কলাবাগান থানা করা হয়। কিন্তু যাত্রা শুরুর সময় থেকে নিজস্ব কোন জায়গা না থাকায় সিটি কর্পোরেশনের জরাজীর্ণ কমিউনিটি সেন্টারে এর কার্যক্রম চলছিল। অবশেষে ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত কমিউনিটি সেন্টার থেকে অস্থায়ীভাবে নতুন ঠিকানা পেল কলাবাগান থানা। ধানমণ্ডির ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টার থেকে কলাবাগান থানা স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমানে পান্থপথের হোটেল সুন্দরবনের পেছনে কাঠালবাগান এলাকায় স্থাপিত হয়। আব্দুল মোমেন গ্রুপ লিমিটেডের সাততলা বিশিষ্ট ভাড়া করা ভবনে অস্থায়ীভাবে এ থানার কার্যক্রম চলবে।
×