ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এ বছর বজ্র দুর্যোগ প্রচলিত সময়ের আগেই শুরু

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২ এপ্রিল ২০১৯

এ বছর বজ্র দুর্যোগ প্রচলিত সময়ের আগেই শুরু

সমুদ্র হক ॥ এ বছর বজ্র (বজ্রপাত) দুর্যোগ সময়ের আগেই শুরু হয়েছে। কাল বৈশাখী ঝড়ও এগিয়ে এসেছে চৈত্রের মধ্যভাগে (এপ্রিলের প্রথমে)। আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, মৌসুমী বায়ুর আগমনের মাসগুলোতে এপ্রিল মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই সময়ে আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা বেশি থাকে। বেড়ে যায় ঝড় বৃষ্টি। বজ্রপাত তারই বাই-প্রোডাক্ট। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে বজ্রপাতের সংখ্যা থাকে কম। এদিকে গত নয় বছরে (২০১০-২০১৮) বজ্রপাতে যত মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় ৩৩ শতাংশই হয়েছে মে মাসে। গত বছরের মে মাস ছিল বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিলের মাস। আবহাওয়া বিভাগ ঝড়ের পূর্বাভাস দিতে পারলেও বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিতে পারে না। গত বছর আবহাওয়া দফতর বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত জানাতে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি জেলায় লাইটেনিং ডিটেক্ট সেন্সর স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। সূত্র জানায়, এখনও তা চালু করা যায়নি। হালে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে বজ্রপাতে লোক মারা যাচ্ছে বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আবহাওয়াবিদ-গণ বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি। বজ্র ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল। অস্ট্রেলিয়ার কটিন বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষক আশরাফ দেওয়ান তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত এলাকা সিলেটের সুনামগঞ্জ। তবে হাওড় ও জলাভূমির আধিক্য এবং জনবসতি কম হওয়ায় সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কম। অর্ধেক ভিন্নমত পোষণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষক জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জে বেশি বজ্রপাত হয়। বেশি মৃত্যু হয় হাওড় অঞ্চলে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যাও বেশি। আবহাওয়া বিভাগ জানাচ্ছে, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপ্রবণ এলাকা। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকে। যে সকল এলাকায় গ্রীষ্মে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সেইসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই বজ্রপাতের শঙ্কা থাকছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বিশে^র গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী বাড়লে বজ্রপাতের শঙ্কা ১৫ শতাংশ, ৪ ডিগ্রী বাড়লে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। ভূবিজ্ঞানীগণ বলছেন, পৃথিবী গ্রহের মধ্যাকর্ষণ শক্তির ভারসাম্য এবং এই শক্তি অক্ষুণœ রাখতে বজ্রপাত প্রাকৃতিক চার্জের কাজ করে। প্রকৃতি বজ্রপাত বাড়িয়ে গ্রাভিটেশন ব্যালান্স ঠিক রাখছে। বর্তমানে বিশ^ উষ্ণায়নের পথে। ‘হিট এজ’ (উষ্ণ বছর) শুরু হয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই গরম বাতাসে জলীয় বাষ্প উর্ধমুখী হয়ে মেঘের ভিতরে যায়। এই জলীয়বাষ্প যত বেশি হবে উষ্ণায়নের ক্ষমতা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে জ্যামিতিক হারে মেঘের সৃষ্টি হবে। বাতাসের এই প্রক্রিয়া উপর ও নিচ দুইভাবে চলতে থাকে। আপড্রাফ হলো মেঘের ওপরের স্তর। ডাউন ড্রাফ হলো মেঘের মধ্যম ও নিচের স্তর। এই মেঘই বজ্র মেঘ। এই দুই মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের পজিটিভ ও নেগেটিভ বিকিরণে প্রাকৃতিক নিয়মেই ভারসাম্যের চেষ্টা করা হয়। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ একত্রিত হয়ে বিদ্যুত সঞ্চালন শুরু হলে বজ্রপাত হতে থাকে। বিদ্যুতের এই সঞ্চালনে বাতাসের তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসে পরিণত হয়। মেঘের অভ্যন্তরে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস সম্প্রসারিত হয়ে ভয়াবহ কম্পনে মেঘ গর্জে ওঠে। আলোর গতিবেগ শব্দের গতিবেগের চেয়ে বেশি হওয়ায় দূরবর্তী আলোকবর্তিকা আগে দেখা যায়। অনেক পরে বজ্রের আওয়াজ শোনা যায়। গত বছর এপ্রিলের শেষের দুই দিন বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে মে মাস অতিক্রম করেছে। ২০১০ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। যে সংখ্যা ৯শ’ ৯৬ জন। তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ১৭ মে বজ্রপাতে মারা যায় ৭ জন। ২০১১ সালের ২২ ও ২৩ মে মারা যায় ৪৫ জন। ২০১২ সালের ২ মে মারা যায় ১৪ জন। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মারা যায় ৩২ জন। ২০১৪ সালের ৩০ মে মারা যায় ৮ জন। ২০১৫ সালের ১৬ ও ১৭ মে মারা যায় ৩৩ জন। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মে মারা যায় ৫৭ জন। ২০১৭ সালের ৯ মে মারা যায় ২১ জন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ২৯ ও ৩০ এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যায় ৩২ জন। মে মাসের ২ তারিখে মারা যায় ১০ জন। ৩ মে মারা যায় ২০ জন। ৬ মে মারা যায় ৪ জন। ৮ মে মারা যায় ৮ জন। এভাবে জুন মাস পর্যন্ত মারা যায় ৮৭ জন। চলতি বছর বজ্রপাতে কত প্রাণহানি ঘটবে এই শঙ্কা রয়েই যায়। ২০১৬ সালের ১১ ও ১২ মে দুই দিনে বজ্রপাতে ৫৭ জন মারা যাওয়ার পর ওই মাসের ১৭ তারিখে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর বজ্রপাতে মারা যায় প্রায় ৩শ’৫০ জনেরও বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বজ্রমেঘ, বজ্রঝড় ও বজ্রপাত কোন একক প্রতিফলন নয়। এটি আবহাওয়ার অনেক উপাদানের সমষ্টিগত ফলাফল। বিশ্বে বজ্রপাত নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত গবেষণা কেন্দ্র ওয়ার্ল্ডওয়াইড লাইটেনিং লোকেশন নেটওয়ার্কের এক তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ হাজার ৮শ’রও বেশি। যা ২০১১ সালে ছিল ৯শ’৭৮টি। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে সরকার সারাদেশে তাল গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। থাইল্যান্ড তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছর সারাদেশে প্রায় ৪৫ লাখ তালবীজ বপন করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাল গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে এইসব তাল গাছ বড় হয়ে বজ্রপাত ঠেকাতে অন্তত ১৪ বছর সময় লাগবে। এর আগে প্রযুক্তিনির্ভর কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আবহাওয়া দফতর বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত জানাতে লাইটেনিং ডিটেক্ট সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেশের ৮টি স্থানে এই সেন্সর বসানো হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, নওগাঁর বদলগাছি, খুলনার কয়রা ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত প্রতিটি সেন্সর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। ঝড় বৃষ্টির সময় কোন জেলার কোন এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে আবহাওয়া বিভাগ। বজ্রপাতের দশ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা আগে এই সঙ্কেত দেয়া যাবে।
×