ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২ এপ্রিল ২০১৯

চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ডাকসুর পর চাকসুর (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। তবে দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এরই মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি চরম জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়া নিয়ে পাঁচ সদস্যের নীতিমালা রিভিউ কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিকে ডাকসুর নীতিমালা বিশ্লেষণ করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে অনেক সুপারিশ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কমিটি এ নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সুপারিশ কখন দেয়া হবে তারও কোন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনে ঘোষণা দিয়ে যত দ্রুততম সময়ে তা সম্পন্ন হয়েছে, চাকসু নির্বাচন শঙ্কামুক্ত উপায়ে সম্পন্ন করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন এ নির্বাচনের অনুষ্ঠানে যতই আন্তরিক বিপরীতে তার চেয়ে বেশি পরিবেশ পরিস্থিতিকে সঙ্কটযুক্ত করে রেখেছে। অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। দফায় দফায় বিভিন্ন ইস্যুতে অনাকাক্সিক্ষত সংঘর্ষের ফলে ২০১৬ সালের ২২ জুলাই চবি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপর ২০১৭ সালের ৪ মে ছাত্রলীগের চবি কমিটি স্থগিত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এ ঘোষণার বছর না ঘুরতেই স্থগিত কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এরপর থেকে কোন কমিটি ছাড়াই চলছে চবি ছাত্রলীগের কার্যক্রম। এ সুযোগে সংগঠন বর্তমানে বহুধাবিভক্ত হয়ে আছে। একে তো প্রধানত এ সংগঠনটির দু’ভাগে বিভক্তি নিয়ে চলে আসছে। এর ওপর একটি গ্রুপ নয় উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর ক্যাম্পাস পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তভাবেই অতিবাহিত হয়ে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি বিভিন্নভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ছাত্রলীগের একটি অংশ চাকসু নির্বাচনের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচীও পালন করে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ছাত্রলীগের বহুধাবিভক্তির অবসান বা নেতাকর্মীদের ঐক্যের কাতারে আনা না গেলে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়। অতীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মৌলবাদী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের একক আধিপত্যে ছিল। এখন সেই পরিবেশ আর নেই। ক্যাম্পাস এখন ছাত্রলীগেরই নিয়ন্ত্রণে। একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখন নিজেরাই বহুধাবিভক্ত। বিভক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যা অতীতে সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মূলত সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নামে ছাত্রলীগের মূল দুটি গ্রুপ থাকলেও মহিউদ্দিন গ্রুপ নয় উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে রয়েছে। ফলশ্রুতিতে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি ঘোষিত হওয়ার পর ছাত্রলীগের এই উপগ্রুপে নড়েচড়ে উঠেছে। গত ২০ মার্চ ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা দেন চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভায় চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সময় সিদ্ধান্ত হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নীতিমালা সংগ্রহ করা হবে। ওইসব নীতিমালা পর্যালোচনা করে চাকসুর বিষয়ে নতুন কমিটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বৈঠক হবে। এরপরই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ২৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭০ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত। এরপর ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ সালে পুনঃপুনঃ চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে জিয়া ও এরশাদ সরকার আমলে তিন দফায় চাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এরশাদ সরকারের পতনের পর চাকসুর আর কোন নির্বাচন হয়নি। সূত্র মতে, ছাত্রলীগ চাকসু’র শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় ফ্যাক্টর। এ সংগঠনটি মূল দুটি গ্রুপের মধ্যে একটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সমর্থিত। অপরটি প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত। এই গ্রুপটি নয় উপগ্রুপে বিভক্ত। এই উপগুলো শাটল ট্রেন বগিভিত্তিক নামে পরিচিত। যেগুলো হচ্ছে সিক্সটি নাইন, ভার্সিটি এক্সপ্রেস, রেড সিগন্যাল, একাকার, উল্কা, বাংলার মুখ, বিজয়, কনকর্ড ও ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার। শাটল ট্রেন বগিভিত্তিক এই উপগ্রুপগুলোর অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। ছোট-বড় অসংখ্য সংঘর্ষের ঘটনা রয়েছে এই উপগ্রুপগুলোর রাজনীতির পথে। কখনও একক আধিপত্য বিস্তার, কখনও বিপরীত গ্রুপকে ঘায়েল, কখনও প্রশাসনের বিরোধিতায় নেমে তা-বের রাজত্ব কায়েম, আবার কখনও অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করার এন্তার উদাহরণ রয়েছে। সঙ্গত কারণে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল ও কমিটি বিলুপ্ত থাকার ঘটনাবলী নিয়ে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি বড় ধরনের অন্তরায় বলে ক্যাম্পাসজুড়ে আলোচিত। ক্যাম্পাস সূত্রে এমন ধারণাও দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল নিয়ে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গেলে রক্তারক্তির ঘটনাও জন্ম দিতে পারে। ক্যাম্পাস সূত্রে আরও জানানো হয়, শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক গ্রুপ সৃষ্টি করে চবিতে ছাত্রলীগের রাজনীতির এমন বিস্তৃতি ঘটেছে যা দেশের কোথাও এমন পরিবেশ দেখা যায় না। ছাত্রলীগের গ্রুপ বা উপগ্রুপের কর্মীদের হাতে রেলের কী পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব পাওয়া না গেলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায় ক্ষতির পরিমাণ মোটা অঙ্কের। কথায় কথায় এরা শাটল ট্রেনের চলাচল বন্ধ করেছে। মূল স্টেশনসহ চলার পথে রেলের কয়েক উপ-স্টেশন যে কতবার ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের কবলে পড়েছে তার হিসাব মেলানোও কষ্টকর। এসব ঘটনাবলীর পরও চবির বর্তমান প্রশাসন ক্যাম্পাসকে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় চাকসু নির্বাচন ঘোষিত হয়ে তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যাম্পাসজুড়ে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি রয়েছে নানা প্রশ্ন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদৌ এ নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে কিনা। চবি ছাত্রলীগকে এক কাতারে আনা যাবে কিনা। ঐক্যের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলে গ্রুপ বা উপগ্রুপের নেতারা তা মানবে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এসব বিষয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত। তবে একথা নিশ্চিত যে, এক্ষেত্রে সরকারী দল আওয়ামী লীগ তাদের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের চবি শাখা নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সকল প্রতিবন্ধকতার অবসান যে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। উদ্ভূত বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চবি ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, প্রশাসন চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক। ইতোমধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাধ্যক্ষ সভা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয়েছে ৫ সদস্যের নীতিমালা রিভিউ কমিটি। এ কমিটি প্রধান হচ্ছেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শফিউল আলম। অন্য সদস্যগণ হলেন আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এবিএম আবু নোমান, লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আমীর মোঃ নসরুল্লাহ, সহকারী প্রক্টর ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক লিটন মিত্র। এছাড়া কমিটির সদস্য সচিব হয়েছেন নির্বাচনী পর্ষদ শাখার প্রধান মোঃ ইউসুফ। ভিসির মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা বিশ্লেষণ করে চাকসু প্রায় ৩০ বছরের পুরনো নীতিমালা আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেলে তা হবে যুগান্তকারী ঘটনা। প্রশাসন এরই অপেক্ষায় রয়েছে।
×