ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পোড়া ক্ষত সত্ত্বেও ফের ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা, পথচারীরা নির্বিকার ॥ চুড়িহাট্টা এখন

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২ এপ্রিল ২০১৯

পোড়া ক্ষত সত্ত্বেও ফের ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা, পথচারীরা নির্বিকার ॥ চুড়িহাট্টা এখন

ওয়াজেদ হীরা ॥ ক’দিন আগেও ছিল থমথমে পরিবেশ। বাতাসে ছিল পোড়া মানুষের গন্ধ। স্বজনদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ছিল শোকে বেদনাবিধূর। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার সেই পরিবেশ এখন স্বাভাবিক। আগুন লাগা সেই ভবনসহ আশপাশে আগুনের ক্ষত চিহ্ন থাকলেও এলাকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা নতুনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করেছেন। পোড়া ক্ষত নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখছেন। জীবনযুদ্ধ চালাতে কেউ কেউ পোড়া ভবন থেকে ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। পাশের মার্কেটগুলোতেও জমজমাট ব্যবসা। পোড়া ভবনের সামনে দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণা থাকলেও এখন তাকানোর সময় নেই ভবনটির দিকে। কালেভদ্রে দু’একজন ভবনের ওপরের অংশে তাকান। দেখে মনে হয় কিছুই যেন হয়নি! অথচ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি কেড়ে নিয়েছে কত প্রাণ, সঙ্গে কত রঙিন স্বপ্ন। বিষাদময় সেই ঘটনা মাস পেরুতেই বাস্তবতার প্রয়োজন সামনে এসে ভুলিয়ে দিচ্ছে ক্ষত। অগ্নিকা-ের সেই ঘটনায় ঘুরে দাঁড়াতে ক্ষতিপূরণও প্রত্যাশা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। গত ২০ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকা-ে ৭১ জন নিহত হন। কেমিক্যাল ও প্লাস্টিকের কারণে আগুন বেশি ছড়ায় বলে জানা যায়। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে এমন একটা দুর্ঘটনার পর এলাকা থেকে কেমিক্যাল ব্যবসা সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এমন উদ্যোগের দৃশ্যমান অগ্রগতিও আছে। বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্যত্র ব্যবসা সরিয়েছেন। পুরান ঢাকায় সরু গলির কারণে যে কোন দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশেও সমস্যা হয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবই যেন থেমে গেছে। বনানী ও গুলশানের অগ্নিকা- চুড়িহাট্টার ঘটনার আলোচনা থামিয়ে দিয়েছে মনে করছেন অনেকেই। এদিকে, সরেজমিনে দেখা গেছে চুড়িহাট্টার স্থানীয় বাসিন্দারা সেই ঘটনা ভুলে নতুন করে সামনে এগোতে চান। চুড়িহাট্টার সেই ভবনটির সামনে ও আশপাশে দোকানগুলোর ব্যবসা চলমান। আর চুড়িহাট্টার পাশের দত্ত রোডে তো বিকিকিনির মেলা। মানুষের ভিড়ে সরু রাস্তায় যাওয়াই মুশকিল। আশপাশের ব্যবসায়ীরা জানান, পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচার তাগিতে ব্যবসা করতেই হয়। এমনিতেই দোকান অনেকদিন বন্ধ থাকার কারণে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন। সরেজমিনে দেখা যায়, পোড়া ভবন হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনেই ফলের দোকানদার ফল বিক্রি করেন। দোকানের সাঁটার থেকে ভেতরেও পোড়া ক্ষত চিহ্ন স্পষ্ট। ফল বিক্রেতা আবুুল কালাম বলেন, ঘটনার দুদিন আগে আমি শরীয়তপুরে বাড়ি যাই। সেখান থেকেই এই ঘটনা শুনি। অনেক দিন দোকান বন্ধ ছিল। এখন পেটের দায়ে ব্যবসা তো করতে হবে। এদিকে, ওয়াহেদ ম্যানশের সঙ্গে লাগানো যে ভবন সেটির পোড়া ক্ষত সারাতে রং করতে দেখা যায়। এই ভবনের নিচতলায় ছিল তাজমহল হোটেল। তাজমহল হোটেলের মালিক আলমগীর শিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ভবনের মালিক প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে রং করাচ্ছেন। দোকান চালু করার অনুমতি পেয়েছি। এতদিন বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়নি। এবার আশা করছি বিদ্যুত সংযোগ পাব। তবে দোকান চালু করতে সময় লাগবে। তবে এপ্রিলের ২০ তারিখের মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করে চালু করার ইচ্ছা আছে। এদিকে, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ও আশপাশ থেকে অনেকেই ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। ভবনে ঝুলিয়ে রেখেছেন ‘স্থান পরিবর্তনে’র ব্যানার। অন্যত্র সরে যাওয়া এমন এক প্রতিষ্ঠান মদিনা ডেকোরেটর। প্রতিষ্ঠানের কর্নধার মোঃ সামছুল হক দোকানের ভেতরেই পুড়ে মারা যান। এখন প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন তারই ছেলে মোঃ মাহবুব। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, এই সংসার জীবনে তো আমাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান অন্য জায়গা সরিয়েও খুব একটা কাস্টমার পাচ্ছি না। অনেক দেনায় পড়ে গেছি। সরকারী আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা শুনতেছি এটা পাব, কি পাব নাকি পাব না সেটা জানি না। শুধু বাবার লাশ দাফনের জন্য দাফন খরচ হিসাবে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিল এর বাইরে চার আনাও পাইনি। সাগর রেফ্রিজারেটর এ্যান্ড ওয়ার্কশপ নামের প্রতিষ্ঠানও ঝুলিয়ে রেখেছেন স্থান পরিবর্তনের ব্যানার। যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোঃ সাগর বলেন, অগ্নিকা-ের পর ভবনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অন্য জায়গা নতুনভাবে ব্যবসা চালানোর সংগ্রাম চালাচ্ছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের তাগিদে সরে আসতে বাধ্য হয়েছি। কবে এই ভবন ঠিক হবে সেটি আমরা কেউ জানি না। তবে আমাদের পুরনো কাস্টমারগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে কিছু কিছু পাই ফোনের মাধ্যমে ঠিকানা নিয়ে। সবারই একই অবস্থা জানালেন তিনি। এদিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাচ্ছেন। ক্ষতিপূরণ পেলে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে ক্ষতিগ্রস্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আর এই ক্ষতিপূরণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন করতে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তরা। আগামী ৫ এপ্রিল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যেখানে এখন পর্যন্ত মোট ২৫টি সামাজিক সংগঠন একত্রিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আরও কয়েকটি সংগঠন এর মধ্যে আসবে। সোনাইমুরি মানবকল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম জনকণ্ঠকে বলেন, আমার দুই ভাতিজা মাসুদ রানা ও রাজু মারা গেছে এই আগুনে। প্রত্যেকটা পরিবারের কর্তা ব্যক্তি বা আয় উপার্জন ব্যক্তি মারা যাওয়াতে পরিবারগুলো আরও বেশি শেষ হয়ে গেছে। সরকারী কিছু সহায়তা হয়ত এই পরিবারের অন্য সদস্যরা একটু বেঁচে থাকার সম্বল খুঁজতে পারবে। আমরা সেই দাবিগুলোই জানাব সরকারকে। এখন পর্যন্ত লাশের দাফন খরচ ব্যতীত আর কোন অর্থ পাননি বলেও জানান। প্রতিদান নামের সংগঠনও অংশ নিচ্ছে এই মানববন্ধনে। সংগঠনের সভাপতি জাহিদ ভূইয়া বলেন, আমরা সব সংগঠন একত্রে মিটিং করে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেব। সেই সঙ্গে রাজধানীর এই আগুন থেকে কিভাবে আমরা ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকতে পারি সে বিষয়ে কথা বলব। আমরা চাই ২০ ফেব্রুয়ারি যেন আমাদের জীবনে আর ফিরে না আসে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের চাকরি ও বাসস্থানের সুবিধা দেয়া হবে। মেয়র বলেন, অগ্নিকা-ে অনেকই স্বজন হারিয়েছেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রেখে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। আবার শিশু সন্তান রেখে বাবা-মার মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। যাদের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে তারা যদি আবেদন করে ডিএসসিসি তাদের চাকরির ব্যবস্থা করবে। সেই সঙ্গে বাসস্থানেরও। এদিকে, পুরান ঢাকা ঘুরে দেখা গেছে চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় সেই থমথমে পরিবেশ নেই। সবই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক পরিবেশ বিরাজমান। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন নামের যে ভবনটিতে আগুনের সূত্রপাত বলে দাবি করা হয় সেই ভবনটি ব্যতীত আশপাশের অন্যান্য ভবনে দোকানপাট খুলে ব্যবসা করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে নেমেছে বাসিন্দারা। গত এক মাস আগে পোড়া ভবন দেখতেন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই ভিড় করত ভবনের সামনে। এজন্য সর্বসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়। পাহারায় ছিল পুলিশের কয়েক সদস্য। মাস না পেরুতেই সবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে! সেই পোড়া ভবনে এখন কারও ফিরে তাকানোরও সময় নেই। পোড়া ভবন এলাকা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে আসলে নন্দ কুমার দত্ত রোডে আশপাশের দোকানগুলো বিক্রিতে সরগরম। দোকানদাররা বলেন, আগুনের খবর এখন অতীত। গুলশান বনানীর খবর লন। আমাদের বেচাকেনা জমজমাট। সামনে বৈশাখ পরে ঈদ। সবমিলিয়ে এখনই কদিন ব্যবসা হবে। দেখা যায় চুড়ি ও চুমকির বাহারি ব্যবসা এখানে। চুড়িহাট্টা পেরিয়ে সামনে আসলে মৌলভীবাজার ও চকবাজার। এই এলাকাগুলো আরও বেশি জমজমাট। পাইকারি ব্যবসায়ী এরা তাদের কথা বলারও সময় নেই। ক্রেতা না হলে কথা বলতেও নারাজ তারা। তবুও একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, ছোট খাট আগুন প্রায় লাগে। এই লেগেছে আবার নেভানোও শেষ। যে আগুনে মানুষ একটু বেশি মারা যায় সেটি নিয়ে একটু আলোচনা হয়। আমরা ব্যবসায়ীরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। চকবাজারের এক খেলা বিক্রেতা বলেন, এখানে তো আগুন নাই সেটি এখন গুলশান বনানীতে। আমরা সবাই ব্যবসায়ী ব্যবসা নিয়েই আছি। কে ক্ষতিপূরণ পেল কে পেল না কি পেল তা জানারও সময় নাই। সবই বাস্তবতা বুঝলেন...! কথাগুলো একবাক্যে শেষ করেন তিনি। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর দোকানের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা ও গুঁড়ো দুধের ব্যবসা হয় মৌলভীবাজারে। অন্যদিকে চকবাজারকেন্দ্রিক বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, তাদের সদস্য সংখ্যা সাড়ে সাত শ’। তবে চকবাজারের বিভিন্ন মার্কেটে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার হবে বলেও মনে করছেন অনেকেই। চকবাজারে ইমিটেশনের গয়না, ব্যাগ, জুতা ও কাপড়ের ব্যবসায় জমজমাট। এছাড়াও পাশেই বেগম বাজারের ফেন্সি মার্কেট, ফয়েজ ম্যানশনসহ আশপাশের মার্কেটে ওয়ান টাইম গ্লাস, প্লেট, বক্স কিংবা খেলনার দোকানে ভরপুর। ঘুপচি ঘরের মতো এসব দোকানগুলোতে লাখ লাখ টাকার বেচাকেনা। বিভিন্ন উপলক্ষ আসার মাসখানের আগেই এসব এলাকার ব্যবসা জমজমাট থাকে। বৈশাখ, লাইলাতুল বরাত, রমজান কেন্দ্রিক ব্যবসা চলছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা ও গুঁড়ো দুধ কিনে নিচ্ছেন বা অর্ডার করছেন খুচরা বিক্রেতারা। জানা গেছে, পুরান ঢাকায় প্রায়ই ছোট খাট আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। কোন কোন ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই নেভানো হয়ে যায়। তবে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুন ছিল ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকা-। সেই আগুনে মারা গিয়েছিল ১২৪ জন মানুষ। এর পর পুরান ঢাকার ভয়াবহ ঘটনা চলতি বছরের চুড়িহাট্টা। যেখানে মারা গেছে ৭১ জন। অথচ নিমতলীর ঘটনার পর এ ধরনের ট্র্যাজেডি রোধ করতে ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। যার কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মনে করে সরকারী কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা চান ব্যবসায়িক পরিবেশ। পৈত্রিক ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা ধরে রাখতে চান তবে সেটা নিরাপত্তার মধ্যে থেকেই। স্থানীয় বাসিন্দারা চায় পরিবার নিয়ে শান্তিতে বসবাস। ভবিষ্যতে এ ধরনের ট্র্যাজেডি রোধ করতে সরকারের সব ধরনের পদক্ষেপে সহায়তার কথাও জানিয়েছেন বাসিন্দারা। নিজেদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা দিতে প্রস্তুত তারা। সরকারী সংস্থাগুলোকে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছেন কেউ কেউ।
×