ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেটলাইন ‘কেরানীগঞ্জ গণহত্যা’ ২ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২ এপ্রিল ২০১৯

ডেটলাইন ‘কেরানীগঞ্জ গণহত্যা’ ২ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল, দিনটি ছিল শুক্রবার। পাকিস্তানী বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ভারত বাংলাদেশের আর্তমানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। গণহত্যার হাত থেকে বাংলার মানুষ যাতে বাঁচতে পারে সে জন্য ভারত তাদের পূর্ব পাকিস্তানের সব সীমান্ত চৌকি খুলে দেয়, যাতে বাধাহীনভাবে অসহায় মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীই প্রথম কোন সরকারপ্রধান যিনি পূর্ব পাকিস্তানে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ করেন। ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতায় বৃহৎ শক্তি রাশিয়াও পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার শিকার আর্তমানবতার পক্ষে এসে দাঁড়ায়। এদিন ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার অপর তীরে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় সমবেত নিরীহ আশ্রয় প্রার্থীদের উপর পাকসেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানীরা ভোর থেকে গণহত্যার উদ্দেশ্যে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। তারা গভীর রাতে বুড়িগঙ্গার অন্য তীরে মিটফোর্ড হাসপাতাল দখল করে নেয় এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫টায় ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা শুরু করার জন্য সংকেত প্রদান করে। এদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা প্রায় ৫ হাজার মানুষকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ছাই হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তানী বাহিনী ৬০ জন লোককে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। লুণ্ঠিত হয় কেরানীগঞ্জ, ধর্ষিতা হয় কেরানীগঞ্জের অনেক মা-বোন। রক্তের বন্যা বয়ে যায় প্রতিটি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বর্বর ঘটনা ‘কেরানীগঞ্জ গণহত্যা’ নামে পরিচিত। কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিঞ্জিরা, কালিন্দি ও শুভাড্যা এই তিন ইউনিয়নব্যাপী এই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসা বাঙালী অফিসার ক্যাপ্টেন আশরাফ ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার যোগ দেন দিনাজপুর উইং এর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন আশরাফকে ঠাকুরগাঁও উইং-এর সঙ্গে যোগ দিতে মির্জা আলমগীর দিনাজপুর যান। টাঙ্গাইল হাইকমান্ড স্থানীয় জেলের সকল বন্দীদের ছেড়ে দেয়। পরে তাদেরই ৮০ জনের একটি দলকে হাইকমান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য নাটিয়াপাড়ায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। অবরুদ্ধ ঢাকায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউর মেয়াদ শিথিল করা হয়। বন্দী পাক অফিসার লে. আতাউল্লাহ শাহকে ঝিনাইদহ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গাতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কমান্ডার মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী তাঁর জবানবন্দী নেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম টি হোসেন ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও আসেন এবং সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি ঠাকুরগাঁও পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণকালে সেখানে এসে সবার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে যান। এতে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জীবন ফিরে আসে। মেজর এম টি হোসেন যুদ্ধে যোগ দিলে সবাই সাদরে তাঁকে তাদের কমান্ডার হিসেবে বরণ করেন। তিস্তা সেতুতে মুক্তিযাদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী বেপরোয়া শেলিং শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা কোন জবাব না দেয়ায় পাকসেনারা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনারা মুক্তিযাদ্ধাদের পুরোপুরি আওতায় এলে মুক্তিযাদ্ধাদের গ্রেনেড ও গোলার আঘাতে বেশকিছু পাকসেনা নিহত হয়। সন্ধ্যায় পাকবাহিনী পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে তিস্তা সেতুতে অবস্থানরত মুক্তিযাদ্ধাদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। এতে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে ইপিআর বাহিনীর সিপাই এরশাদ আলী ও সিপাই আতাহার আলী মল্লিক শহীদ হন। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এবং স্টেট ব্যাংক এলাকায় পাকসেনাদের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ইপিআর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধ সমগ্র শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম তৎকালীন রামগড় মহকুমা সদরে আসেন। তিনি সঙ্গে করে প্রচুর অর্থ নিয়ে আসেন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবী সরকারের হাতে তুলে দেন। রামগড় মহকুমায় তিনি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে তিনি রামগড় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমায় চলে যান এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় রাঙ্গামাটিতে এসে পুলিশ, আনসার ও ইপিআরদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযাদ্ধাদের মাঝে বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা নেন। তাঁর নির্দেশেই এডিসি সামাদ বরকল সীমান্ত পার হয়ে ভারতের দেমাগ্রীতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ শহরের সকল বাড়ি ও গাড়ির নম্বর এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড উর্দুতে লেখার নির্দেশ জারি করে। বলা হয়, অনুপস্থিত সকল কর্মচারী অবিলম্বে কাজে যোগদান করলে তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কোন নাগরিক ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযাদ্ধাদের) আশ্রয় দিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবেÑ এই মর্মে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা জারি করে। ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযাদ্ধাদের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাকিস্তান ভারতের কাছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। হাইকোর্টের ৩৮ জন আইনজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের ঘরোয়া বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপকে ‘নগ্ন ও নির্লজ্জ’ অভিহিত করে এর প্রতিবাদ জানায় এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযাদ্ধাদের) বাধাদানের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানায়। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের মনোভাবের প্রতি তাঁর কোন আস্থা ছিল না বলেই তিনি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতা ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়েছেন। সকালে ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মুক্তিসংগ্রামের এইদিন কর্নেল এমএজি ওসমানী প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় পৌঁছেন এবং ওইদিন বিকেলে তেলিয়াপাড়া সীমান্তের ‘নোম্যানস ল্যান্ডে’ বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় আইজি মি. ভিসি পান্ডে এবং আগরতলার ডিসি মি. সায়গল তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে আসেন। তাঁরা তেলিয়াপাড়া পৌঁছে লে. কর্নেল এমএম রেজা, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর সাফায়েত জামিলসহ আরও কয়েকজন সেনা কর্মকতার সঙ্গে সাক্ষাত করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার রণকৌশল বিষয়ে শলাপরামর্শ করেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘নিউ স্টেটসম্যান’ ‘উইপ ফর বাংলাদেশ’ (‘বাংলাদেশের জন্য কাঁদো’) শিরোনামে একটি হৃদয়স্পর্শী সংবাদ প্রকাশ করে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিভিন্ন হৃদয়স্পর্শী ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছিল। লন্ডনের বিখ্যাত ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় ২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে সাংবাদিক লুইস হেরেনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর শুরুতে বলা হয়- ‘পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে শেষ করা, যা ভালভাবেই সম্ভব হাসিল হয়েছিল।’ একাত্তরের এইদিনে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়ন, ব্যাপক প্রাণহানি বন্ধ তথা তাদের প্রতি ন্যায্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে সোভিয়েত জনগণের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য একটি চিঠি লিখেন। তা অনেকটা এ রকমÑ সম্মানিত প্রেসিডেন্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, ঢাকায় শান্তি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সামরিক বাহিনী কর্তৃক চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ও শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ওখানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এবং যার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অগণিতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু, ধ্বংস আর দুর্গতির শিকার হওয়ার খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণও শঙ্কিত না হয়ে পারে না। অল্প কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ যারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ সবসময়ই পাকিস্তানের শুভাকাক্সক্ষী এবং তাদের উন্নয়নের প্রত্যাশী। দেশের যে কোন বড় সমস্যা হোক না কেন গণতান্ত্রিক সমাধানে সোভিয়েত জনগণ সমভাবে আনন্দিত হয়েছে। আমরা মনে করি এই সময়ে পাকিস্তান যে জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, কোন শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করা সম্ভব এবং সেটাই হওয়া উচিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর দমনপীড়ন, অত্যাচার আর মৃত্যু সমাধানের পথকে রুদ্ধ করে দিবে, আর তা মানুষের মৌলিক স্বার্থহানি ঘটাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য যে, যত দ্রুত সম্ভব মৃত্যু-হানাহানি বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার-জুলুম কমিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করুন। আমরা বিশ্বাস করি, একমাত্র এই পথেই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা সম্ভবপর হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ যে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার মানবিক মূলনীতি অনুসারে আমরা এই অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম জনগণের সম্মতিতেই তাদের সবার জন্য এই অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমরা আশা করব, এ চিঠির প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে আপনি সক্ষম হবেন। যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক,এই আমাদের প্রত্যাশা। এন পদগর্নি, মস্কো, ক্রেমলিন ২ এপ্রিল, ১৯৭১। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×