ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’ গিলে খাচ্ছে শিশুদের মনস্তত্ত্ব!

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১ এপ্রিল ২০১৯

 ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’ গিলে খাচ্ছে শিশুদের মনস্তত্ত্ব!

সমুদ্র হক ॥ বাড়ি কিংবা স্কুলে খেলার মাঠ নেই। কোথায় খেলবে! কেউ কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায় না। সমবয়সীদের সঙ্গে কোথায় ছোটাছুটি করবে। দাদু, নানু, স্বজনরা কাছে নেই। বেড়াতেও আসে না। কার কাছে গল্প শুনবে, দুষ্টুমি করবে। অপার মমত্বের বায়না ধরবে। কখনও বাবা, কখনও মা-বাবা দু’জনই অফিসে যায়। কাজের বুয়া আর কতক্ষণই থাকে। আর থাকলেই বা কি। এমন একাকীত্বে করবেটা কি? একান্নবর্তী পরিবারের দিন এখন অনেকটাই বাসি। ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’র ধকল তাই সইতে হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের। শিশুরা (জাতিসংঘের সংজ্ঞায় ১৮ বছর পর্যন্ত) নিজেরাই খুঁজে পেয়েছে আরেক জগত। কঠিন বাস্তবতাই তাদের টেনে নিয়েছে পরাবাস্তব জগতে (ভার্চুয়াল লাইফ)। এই জীবনের ই-পর্দা তাদের কাছে এখন আকর্ষণীয় বস্তু। বর্তমান শিশুদের ট্যাব, স্মার্টফানের পর্দা বেশি আকর্ষণ করে। কিছুদিন আগেও শিশুরা ডেস্কটপে নানা ধরনের মজার খেলা খেলত (কম্পিউটার গেম)। এখন ডেস্কটপ কাছে টানে না। কাছে টানে ছোট পর্দার (মনিটর) ট্যাব, সেলফোন। সেলফোন (মোবাইল ফোন) নির্মাতারা ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি স্ক্রিনের সেলফোনের মধ্যে গোটা বিশ্বকে তুলে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শিশু মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে মজার সব এ্যাপ্লিকেশন (এ্যাপ) ধারণের ব্যবস্থা করেছে। আট গিগাবাইট (জিবি) থেকে এক শ’ চৌষট্টি জিবি (কখনও আরও বেশি) ধারণক্ষমতা আছে ওসব সেটে। ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে ‘র‌্যানডম এ্যাকসেস মেমোরি’ (র‌্যাম) দুই জিবি থেকে ষোলো জিবি পর্যন্ত বাড়িয়েছে। প্রস্তুতকারক ট্যাব ও স্মার্টফোনের দাম কমিয়ে সহজলভ্য করে দিচ্ছে। নগর জীবন পেরিয়ে গ্রামীণ জীবনে এখন অনেকের ঘরে স্মার্টফোন পৌঁছে গেছে। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোরের হাতে পৌঁছে গেছে ট্যাব ও স্মার্টফোন। অনেক সময় গৃহকর্তা-গৃহকত্রী-চাকরিজীবী হওয়ায় সন্তানের হাতে তুলে দেন ট্যাব। এই শিশু- কিশোররা পরাবাস্তব জগতের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে বেশি বেশি সময় কাটায় ট্যাবের স্ক্রিনে। যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক্সের’ এক জরিপে বলা হয়েছে যেসব শিশু-কিশোর দিনের অনেকটা সময় টিভি দেখে, কম্পিউটারে খেলে, ট্যাব ও স্মার্টফোনের আসক্তিতে থাকে তারা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। অস্বাভাবিক আবেগপ্রবণ হয়। তাদের আচরণে পরিবর্তন আসে। বর্তমান বিশ্বে ইলেক্ট্রনিক (ই) যন্ত্রপাতির প্রতি শিশুদের আকর্ষণ বেশি। এ্যান্ড্রয়েড ফোন, আইফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার প্রতি শিশুদের এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন অভিভাবক মনে করেন এভাবে শিশুরা স্মার্ট হচ্ছে (!)। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা ১০ থেকে ১২ বছরের শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, যারা দিনে ৫ ঘণ্টা কম্পিউটার, ট্যাব, সেলফোনের পর্দার সামনে থাকে তাদের মেধার বিকাশ ঠিকমতো হয় না। কম বয়সেই স্ক্রিনের আলোকরশ্মিতে আক্রান্ত হচ্ছে চোখ। যারা লেখাপড়ার পাশাপাশি বাইরের জগত সম্পর্কে জানার জন্য অল্প সময় ট্যাবে বসে, বই পড়ে তাদের মেধার বিকাশে নানা মাত্রা যোগ হয়। গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন- শিশুরা অবশ্যই নতুন কিছু সম্পর্কে জানবে। জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে। পাশাপাশি শিশুদের থাকতে হবে প্রকৃতির মধ্যে। যেমন মাঠে খেলাধুলা, সমবয়সীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, স্বজনদের সান্নিধ্য প্রাপ্তি, পরিবারের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, একাডেমিক পাঠের বাইরে নানা ধরনের বই পড়া, নতুন কিছু দেখা ও শেখা। শিশুর সময়গুলো এমনভাবে সাজানো দরকার যাতে প্রতিটি মুহূর্তই তাদের কাছে মধুর অভিজ্ঞতা হয়ে ধরা দেয়। এভাবে শিশুরা সুস্থ মানসিকতায় সৃষ্টিশীল হয়ে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠে। তারা বুঝতে শেখে বাস্তবতা ও পরাবাস্তব ভুবনের পার্থক্য। প্রখ্যাত এক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, একবিংশ শতকের এই সময়টা পৃথিবী এত দ্রুত চলছে যে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। নিকট অতীতে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে একটা মধুর বন্ধন ছিল। বলা হয় ফ্যামিলি বন্ডিং। বর্তমানে সবকিছু ভেঙ্গে গিয়ে অণু পরিবারে (নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি) রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে মা, বাবা ও সন্তানকে নিয়েই পরিবার। জীবিকার প্রয়োজনে বাবাকে রোজগার করতে হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতে হয় বাইরে। কখনও বাবা-মা দুজনকেই চাকরি করতে হয়। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আগমনও বেশি হয় না। এমন এক অবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠছে বর্তমানের শিশু।
×