ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত

ছাত্ররাজনীতি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১ এপ্রিল ২০১৯

 ছাত্ররাজনীতি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে

সায়েম খান ॥ ২৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ না হওয়াটা আমাদের জন্য ছিল অনেক হতাশার। এই অচলায়তন কাটিয়ে ছাত্ররাজনীতি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে। গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন হতে পারে ছাত্ররাজনীতির নবযুগের প্রবেশদ্বার। যে যুগ হাতছানি দেয় সার্বিক সম্ভাবনা, সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রার। শহীদের রক্তস্নাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুণ্যভূমিতে বর্তমান রয়েছে যে প্রজন্ম সেই আমাদের অনুভূতিতে ডাকসু ছিল সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। ডাকসু শুধু শিক্ষার্থীদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার মঞ্চ নয়, নয় শুধু ইট-পাথরের দালান। ছাত্র সংসদ নির্ণয় করে গণতান্ত্রিক পরিবেশের গতিময় সংস্কৃতি। যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবেশসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়। এই সংস্কৃতির মধ্যে শুধু সুনাগরিকতার নিশ্চয়তা নয় বরং এটি মননশীলতা বিকাশের উর্বরভূমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয় যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদের কার্যকারিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে পুরো প্রতিষ্ঠানের মনস্তত্ব। যে বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে প্রতিটি ক্রান্তিকালে পথ দেখিয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর নির্ধারণ করতে পারাটাই হবে নির্বাচিত সংসদের সদস্যদের সক্ষমতার জানান দেয়া। পরিসর নির্ধারণের জন্য দরকার কেন্দ্রবিন্দুকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত, সুসংহত ও শক্তিশালী করা এবং অতীতের মতো ডাকসুকেই হতে হবে সেই কেন্দ্রবিন্দু। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে না। আক্ষরিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও আমরা জানি ব্যবহারিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাছে কতটা দায়বদ্ধ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সদিচ্ছা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে এতো বড় ঝুঁকি নেয়াটা সম্ভবপর ছিল না। ফলে সর্বাগ্রে যে মানুষটির প্রতি আমাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা উচিত তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটা ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে স্বীকার করে এসেছে। নির্বাচিতদের মধ্যে দুটি পদ ব্যতীত সবগুলোতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ’-এর প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ভিপি পদে ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ থেকে নির্বাচিত নুরুল হক নুর শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত সকলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের কণ্ঠস্বরকে অবারিত করার জন্য এই ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই নির্বাচিত সংসদ থেকে কেউ কেউ শেখ হাসিনাকে ডাকসুর ‘আজীবন সদস্য’ ঘোষণার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৭২ সালে নির্বাচিত নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্য ঘোষণা করেছিল। এ ব্যতীত অন্য কোন রাষ্ট্রীয় শাসককে এতটা আস্থায় ছাত্রসমাজ নিতে পারেনি। ]ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রসংগঠনের আবেদন আর আগের মতো নেই, স্বত:সিদ্ধ কথা না হলেও বর্তমান সময় তারই প্রমাণ দেয়। নব্বই এর আগে সংগঠনের আবেদনে ছাত্রনেতা নির্বাচিত হতো। এখন আমরা দেখি, প্রত্যেকটা সংগঠনে কতিপয় ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি হয়েছে। ছাত্রনেতা তৈরি করার ক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অতীতের তথ্য-উপাত্ত থেকে মোটাদাগে বুঝতে পারি। ষাটের দশকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নামক সংগঠন থেকেই আসত নির্বাচিত ছাত্রনেতারা। স্বাধীনতা পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময় ছাত্রলীগ বড় সংগঠন হিসেবে ক্যাম্পাসে থাকলেও বিভিন্ন প্রভাবক এবং ষড়যন্ত্রের কারণে ডাকসুতে প্রধান দুটি পদে (বাকি পদগুলো বা অন্য জায়গায় ছাত্রলীগের সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল) জাসদ ছাত্রলীগের দাপট ছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে খণ্ড খণ্ডভাবে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত থাকলেও ছাত্রলীগ সবসময় তার অবস্থানে ছিল সরলরৈখিক। নব্বইয়ের পরে ছাত্রসংগঠনের নামের উপর ছাত্রদের আবেদন কিছুটা কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো ছাত্ররাজনীতিতে বৈষয়িক চিন্তার প্রভাব, ছাত্রসংগঠনগুলোর মান্ধাতা আমলের গৎবাঁধা সূত্রে চলা এবং সময়ের দাবি ধরতে না পারা। সময়ের সঙ্গে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়। সুতরাং পরিবর্তন দরকার হয় রাজনৈতিক কলাকৌশলের। ছাত্র সংগঠনগুলোর অধিকাংশ নেতৃত্বই সেদিকে ছিল বেখেয়ালি। এবারের ডাকসু নির্বাচনের কিছুদিন আগে বাম দিকের নেতৃত্ব দেয়া এক ছাত্রনেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘নুরুল হক নুর’দের প্যানেলের বিষয়ে তাদের মনোভাব কি?’ তখন সে বলেছিল, ‘নুররা কোন রাজনৈতিক শক্তি নয়। সুতরাং তারা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোন ফ্যাক্টর বা প্রভাবক নয়।’ এই হলো আমাদের সংগঠনগুলোর অনুমানভিত্তিক রাজনীতি। শিক্ষার্থীদের মানসপটে অতি দ্রুত গতিতে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটার দিকে কারোই লক্ষ্য ছিল না। সময়ের ডাকে শিক্ষার্থীদের মন:স্তত্ত্বের সঙ্গে যারা সামিল হয়েছিল তারা সংগঠনের কোন প্লাটফর্ম ছাড়াই এগিয়ে গেল। আর ফলস্বরূপ এই মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নুর ছাত্রসমাজের চূড়ান্ত প্রতিনিধি। তৃতীয় পক্ষ বাইরে থেকে নুর ও ছাত্রলীগের মধ্যে বোঝাপড়ায় সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইবে। সময়টা ছাত্রলীগের চাইতে নুরের জন্য বেশি সংকটাপন্ন। নুর ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি মানে হলো, সে এখন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ডাকসুতে ছাত্রলীগেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ডাকসুতে নুরকে তাদের নিয়েই চলতে হবে। সুতরাং অন্য কারও রাজনৈতিক প্রচারণায় পড়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দোষারোপ করাটা হবে তার রাজনৈতিক বালখিল্যতা। বরং আগামী এক বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রলীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করা হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। নুরের সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এ লড়াইকে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। আমরা বার বার গৌরবময় অতীতের দিকে ফিরে তাকাই অতীতমুখী হওয়ার জন্য নয়। বরং অতীতকে পর্যালোচনা করে বর্তমানকে আঘাত করে ভবিষ্যতের পন্থা নির্ধারণের জন্য। সর্বোপরি আমরা প্রত্যাশা করি, অচলায়তনের বদ্ধ দুয়ারে এই আঘাতের মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির প্রাণভোমরা মুক্তি পাক। লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা
×