ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মৃৎশিল্পীদের সুদিন

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১ এপ্রিল ২০১৯

 মৃৎশিল্পীদের সুদিন

উপমহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতি সুপ্রাচীন। মহেঞ্জোদারো-হরাপ্পা সভ্যতায় এর সম্যক প্রমাণ মেলে। তবে কালের বিবর্তনে মৃৎশিল্পী ও কুম্ভকারদের সেই সুদিন অন্তর্হিত হয়েছে অনেক আগেই। নানারকম ধাতুর আবিষ্কারসহ দৈনন্দিন তৈজসপত্র, বাসনকোসন, হাঁড়ি-পাতিল, কলস ইত্যাদিতে ধাতুর ব্যবহার বাড়তে থাকলে মৃৎশিল্পীদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। মাটির তৈজসপত্র ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী বিধায় সেসব বিদায় নেয় কালক্রমে। ঘর-গৃহস্থালির দৈনিক ব্যবহার্য জিনিসপত্রের তালিকার স্থান পেতে থাকে প্রথমে লোহা, ব্রোঞ্জ, তামা, কাঁসা, এ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত এবং সর্বশেষ মেলামাইন ও প্লাস্টিকের সামগ্রী। এসব যেমন সস্তা, তেমনি টেকসই। রক্ষণাবেক্ষণের খরচও তেমন নেই বললেই চলে। ফলে স্বভাবতই কুমার সম্প্রদায় ও মৃৎশিল্পীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে বাজার প্রতিযোগিতা থেকে। অধিকাংশই জীবন-জীবিকার অনিবার্য তাগিদে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে বেছে নেয় ভিন্ন পেশা। এক সময় পূজা-অর্চনার বেশি প্রচলন থাকায় কুমার শিল্পীরা নানা দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করেও টিকে ছিল কায়ক্লেশে। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা বাড়তে থাকায় পূজার সংখ্যাও কমে যেতে থাকে। তবে বড় বড় এই যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালীপূজাগুলো টিকে থাকে। এসবই প্রধানত ঋতুভিত্তিক এবং সাময়িক চাহিদার অনুষঙ্গ। এ দিয়ে আর যাই হোক পরিবার-পরিজন নিয়ে সাড়া বছর জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা প্রকট। আর সেটি হলো কাঁচামালের তীব্র সঙ্কট। মৃৎশিল্পের প্রধান উপাদান পলিমাটি তথা কাদামাটি, বিশেষ করে বেলে দো-আঁশ মাটি। অধুনা এ মাটিও অতি দুর্লভ বস্তু। কেননা দেশের অধিকাংশ নদ-নদী হেজে-মজে গেছে ইতোমধ্যেই। অধিকাংশ চরাঞ্চলই ধু-ধু বালি অধ্যুষিত, বালিকবলিত। মৃৎশিল্পের উপযোগী ভাল মাটি পাওয়াই দুষ্কর, দুঃসাধ্য; যাওবা মেলে তা দুর্মূল্য। এ দিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করে বাজারমূল্যে পোষায় না। ফলে মৃৎশিল্পী গোষ্ঠী যারা এখন পর্যন্ত কায়ক্লেশে টিকে আছেন তারা ঝুঁকে পড়েছেন বিকল্প কাঁচামালের দিকে। এই যেমন, বাঁশ, বেত, শোলা, তালপাতা, টিন, হার্ডবোর্ড, কাগজ, মোম, পশুর চামড়া, এমনকি প্লাস্টিকের ওপর। এসব কাঁচামাল দিয়ে বিবিধ পণ্য, ছোট-বড় খেলনা ও শো-পিস তৈরির পাশাপাশি তৈরি করছেন ঢাকঢোল, টমটম, ফুল, পাখি, লতাপাতা, তালপাতার সেপাই, পশুপাখি, বাঁশি ইত্যাদি নানারকমের রং-বেরঙের খেলনা সামগ্রী। বাস্তবতা হলো, পেশায় টিকে থাকার অনিবার্য তাগিদ ও প্রয়োজনেই তাড়া এসব বিকল্প কাঁচামাল এবং খেলনা পণ্য তৈরির উপায় বেছে নিয়েছেন। এতে করে দেশীয় মৃৎশিল্পের পাশাপাশি চিরায়ত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, চারু ও কারুপণ্যের ঐতিহ্য একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে বাজার প্রতিযোগিতায়ও টিকে থাকা যাচ্ছে। তবে সমস্যা আছে এখানেও। প্রায় সব নির্মাণ সামগ্রী তথা রংসহ বাঁশ, বেত, টিন, তালপাতা, কাগজ ইত্যাদির দামও বাড়ছে দিন দিন। সেই অনুপাতে তাদের রয়েছে তীব্র পুঁজি সমস্যা ও সঙ্কট। অর্থের অভাবে তারা একবারে বেশি মালামাল কিনতে ও সরবরাহ করতে পারেন না, মজুদ তো দূরের কথা। তাদের কেউ ঋণও দেয় না। ফলে অর্থ সঙ্কট তাদের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা এদিকে দৃষ্টি দিতে পারে। সামনেই আসছে চৈত্র মাসের শেষ ও শুভ বাংলা নববর্ষ। গ্রাম-বাংলার প্রায় সর্বত্র চৈতালী ও বৈশাখী উৎসব, মেলা ও পার্বণ কমবেশি সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ নগরজীবনেও এই আনন্দ-উৎসবের প্রবল ছোঁয়া লাগে। ফলে বলা যায়, মৃৎশিল্পী তথা কুম্ভকারদের এখন আহার-নিদ্রা নেই অবস্থা। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে এখন লেগেছে শশব্যস্ত হাওয়া। চৈত্র-বৈশাখের আসন্ন মেলাকে ঘিরে সাজ সাজ রব। এটুকু তাদের প্রান্তিক অভাবগ্রস্ত জীবনে এক টুকরো আনন্দ সংবাদ বৈকি। বেঁচে-বর্তে থাকুক আবহমান গ্রাম-বাংলার নান্দনিক চারু-কারু-মৃৎ ও কুটির শিল্প।
×