ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ৩১ মার্চ ২০১৯

অগ্নিঝরা মার্চ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালী জাতিকে একটি যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ অনিবার্য-এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কাছে পরিষ্কার ছিল। সেজন্য তিনি যেমন আপামর বাঙালীকে যুদ্ধে যাবার জন্য ব্যাকুল করে তুলেছিলেন, সে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও একটা বিকল্প নেতৃত্বও তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মনে আস্থা জন্মেছিল যে, তার অনুপস্থিতিতে সেই বিকল্প নেতৃত্ব যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে মুজিবনগর সরকার। এই সরকার গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়। অগ্নিঝরা মার্চের এইদিনে এক লাখের বেশি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এইদিনে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। লোকসভায় এক সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে পূর্ববাংলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পূর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা ও সহায়তাদানে ঐকমত্য প্রকাশ করা হয়। বিকেল ৪ টা ৩০মিনিটে কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ-ইপিআরের সম্মিলিত ৫০০ যোদ্ধা পাকিস্তানী বাহিনীর ডেল্টা কোম্পানির সৈন্যদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা চালায়। অগ্রসরমান জনতার সমুদ্র থেকে উত্থিত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং অব্যাহত গুলিবর্ষণে ডেল্টা কোম্পানির প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। সকাল ৭টায় চট্টগ্রামের হালিশহর কাঁচা সড়ক জংশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড আর্টিলারি, ট্যাঙ্কসহ ইপিআর ব্যূহ ভেদ করে হালিশহরের দিকে অগ্রসর হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে ১৫ জনের বেশি ইপিআর সদস্য শহীদ হন। এই দিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কুড়াল, কিরিচ আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ ইপিআর সদস্য এবং হালিশহরের মধ্যম নাথপাড়ায় ৩৯ সহ ৭৯ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিহারীরা জল্লাদ শওকতের নেতৃত্বে দুপুরের দিকে নাথপাড়ায় হত্যাকা- শুরু করে। বেলা ২ টায় চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতর, হালিশহরের পতন ঘটে। ভোরে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে অবস্থান করা পাকিস্তানী সেনাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়; কিন্ত পাকিস্তানীদের ভারি অস্ত্রের গোলা বর্ষণে তাদের ধ্বংস করতে পারেনি। দিনের যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকা অর্ধশতাধিক পাকিস্তানী সেনা ওই রাতে দুটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়িতে করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পড়ে যায় মুক্তিযাদ্ধাদের এ্যামবুশে। মেজর শোয়েবসহ বেশিরভাগ পাকিস্তানী সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। কুষ্টিয়াই একমাত্র জেলা যেটা শত্রুমুক্ত হয়েছে যুদ্ধের প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যেই। এর ধারাবাহিকতায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব হয়ছিল। এই দিন নওগাঁর মুক্তাঞ্চল থেকে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বাঙালী মুক্তিবাহিনী, পুলিশ-আনসার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিবেন। মনে রাখিবেন হয় আমরা জয়ী হইব, নতুবা ধ্বংস হইব। মাঝামাঝি কোন পথ আর নাই। দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশসহ চারটি পত্রিকাতেই ইস্ট পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার পথে-এ কথা ফলাও করে লেখা হয়েছে। পূর্বদেশে লেখা হয় ‘শান্তিপ্রিয় বেসামরিক নাগরিকদের যেসব সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী হয়রানি করছিল, তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত হয়েছে।’ মর্নিং নিউজ হেডলাইন দিয়েছে: ইয়াহিয়াজ স্ট্যান্ড টু সেভ পাকিস্তান প্রেইজড। পাকিস্তান রক্ষায় ইয়াহিয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রশংসিত। ইয়াহিয়া লডেড ফর রাইট স্টেপস টু সেভ কান্ট্রি- দেশরক্ষায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইয়াহিয়া নন্দিত। ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঐ ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল। বিবিসি-১৯৭১, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ থমসন রয়টার্স ১৯৭১- ‘বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।’ এএফপি বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালীদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ ১৯৭১ সালে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’ ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান দুই টুকরো হলো। পূর্ব পাকিস্তান হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গেল পাকিস্তান নামে। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় বীরের মর্যাদা পেলেন। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর উত্তরণ ঘটল প্রধান নেতা হিসেবে। ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন পর্দার অন্তরালে, চিরতরে। ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক সংঘাত এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা বাংলাদেশে একটি অনিবার্য রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও পাকিস্তানে এ ধরনের পরিণতির জন্য সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে তৈরি ছিল না।
×