ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রহস্যজনক- এটা স্রেফ আগুন নাকি নাশকতা

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩১ মার্চ ২০১৯

রহস্যজনক- এটা স্রেফ আগুন নাকি নাশকতা

আজাদ সুলায়মান ॥ দু’বছর আগেও কাঁচাবাজার লাগোয়া ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। দুটো মার্কেটের আগুনের ধরন, গতি-প্রকৃতি ও ক্ষয়ক্ষতি ছিল ভয়ানক। তখনও ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আগুনের নেপথ্য রহস্য উদঘাটন করা হোক। এবারও ব্যবসায়ীদের দাবি, এটা স্রফে আগুন নাকি নাশকতা তা আগে বের করা হোক। তারপর ক্ষতিপূরণ ও অন্যকিছু। মার্কেটের মুরগি ব্যবসায়ী বাবুলের ভাষ্যমতে, এখানকার কাঁচা ও পাকা- দুটো মার্কেটের ব্যবসায়ীরাই দুভাগে বিভক্ত। একপক্ষ চায়- এখানে বর্তমানে যে যেভাবে আছে, সেভাবেই ব্যবসা চালিয়ে যাক। অপরপক্ষ চায়, দেশ এখন অনেকটাই এগিয়েছে। গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় এ ধরনের দৈন্যদশায় কাঁচাবাজার চালু রাখাটা কিছুতেই শোভনীয় ও মর্যাদার নয়। কাজেই এখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বজায় রেখেই তৈরি করা হবে অত্যাধুনিক মানের সুপার মল। দুপক্ষের টানাপোড়েনের মাঝেই মাত্র দুবছরে ঘটে গেছে দু’দুটো অগ্নিদুর্ঘটনা। উল্লেখ্য- এর আগে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি একই মার্কেটে আগুন লেগেছিল। সেই সময় ১৬ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। সেবার মার্কেটটির বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তখন তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকও অগ্নিদুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখানে আর কোন অস্থায়ী মার্কেট রাখা যাবে না। নিরাপত্তার স্বার্থে হলেও এখানে অত্যাধুনিক মানের মার্কেট নির্মাণ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা হবে। তার এ ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই তৈরি করে ফেলেন ভস্মীভূত মার্কেটটি। কিন্তু তাতে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়নি বহুদিন। শেষ পর্যন্ত আনিসুল হকও ব্যবসায়ীদের দাবির প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি প্রকাশ করার পর অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করে মার্কেটটি চালু করা হয়। এ অবস্থায় ফের পাশের কাঁচা মার্কেটে শনিবার ভোরে আগুন লেগে যায়। একটি ছোট পানের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে এবং সবকটি দোকান পুড়ে যায়। এদিকে সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ওই জায়গায় পাশাপাশি মোট চারটি মার্কেট। কাঁচাবাজারের সামনেই ছয়তলা গুলশান শপিং মার্কেটটি ব্যক্তি মালিকাধীন। কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশে দু’তলা ডিএনসিসি পাঁকা মার্কেট। আর তার পশ্চিম পাশে ছয়তলা মসজিদ কমপ্লেক্স মার্কেট। এ তিনটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীন। কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি ১৯ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন সিদ্দিকী জানান, সাত বিঘা জমির ওপর এই মার্কেটের পাঁকা মার্কেট অংশটি আছে ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে। ১৯৮২ সালে সিটি কর্পোরেশন কাঁচা মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেয়। ২০০৩ সালে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে মালিক সমিতির সঙ্গে কথা না বলেই এই মার্কেটের জায়গায় ১৮ তলা গুলশান ট্রেড সেন্টার নির্মাণের দরপত্র দেয়া হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েও তা করতে অপারগতা জানালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মেট্রো গ্রুপের আমিন এ্যাসোসিয়েটস ওভারসিজ কোম্পানি কাজটি পায়। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই চুক্তি স্থগিত করে ভবনে ডিএনসিসির মালিকানা বাড়াতে বলা হয়। এরপর ডিএনসিসির মালিকানা বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করে নতুন চুক্তি করা হয়। কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদের অভিযোগ, এই মার্কেট নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে মামলা চলছে। মামলা চলার কারণে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে পারছিল না মেট্রো গ্রুপ। এতে করে সিটি কর্পোরেশনের অনেক অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর অসুবিধা হয়। সেজন্যই দুবছর আগের অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ছিল নাশকতা। কিছু অসাধু কর্মচারী ও মেট্রো গ্রুপ এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে আমাদের সবার বিশ্বাস। এবারও একই কায়দায় ঘটেছে একই ধরনের আগুন। এ বিষয়ে মার্কেটের এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, মাত্র দু’বছরের মাথায় আগের ঘটনাস্থলের লাগোয়া এই কাঁচা মার্কেটের আগুন নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে ক্ষোভ, সন্দেহ ও অসন্তোষ দানা বাধছে। পান দোকানী করিমের ভাষ্যমতে, এটা সবারই প্রশ্ন, এ আগুন ¯্রফে দুর্ঘটনাজনিত নয়। এখানে অন্যশক্তি কাজ করছে। এদিকে ডিএনসিসি কাঁচাবাজার ও সুপারমার্কেট কর্তৃপক্ষকে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখতে তিন থেকে চারবার সতর্ক করে নোটিস দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়াস সার্ভিস। পরিচালক মেজর শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, এই মার্কেটে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে তাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা একই মার্কেটে অগ্নিকা-ের ঘটনার পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তিন থেকে চারবার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেয়া হয়। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। স্থায়ী মার্কেটের পক্ষে হানিফ-আতিক ॥ দু’বছর আগে আগুন লাগার পর তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিএনসিসি মার্কেট ভেঙ্গে শপিংমল তৈরি করা হবে। এবার দ্বিতীয় দফায় অগ্নিকা-ের পর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম দুজনেই সেটা পুনর্ব্যক্ত করেন। শনিবার কাঁচাবাজারের অগ্নিকা-ের ঘটনা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, এই মার্কেটটি ভেঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের শপিংমল করার কথা ছিল। যেকোন কারণে এটা হয়নি। কিন্তু এখন জনগণের স্বার্থে যেকোন মূল্যে এটাকে (ডিএনসিসি মার্কেট) ভেঙ্গে মার্কেট তৈরি করতে হবে। মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, কাঁচাবাজারের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমার দু’পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তারা আজকেই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। যেসব ব্যবসায়ীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন খোঁজ-খবর নিচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় শনিবার মেয়র আতিকও বলেছেন, আমরা এখানে ডিএনসিসি স্থায়ী মার্কেট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামলার জটিলতা আছে। আমরা এই মামলার নিষ্পত্তি করে যত দ্রুত সম্ভব স্থায়ী মার্কেটের দিকে যাব। যেখানে অগ্নিনির্বাপণসহ ব্যবসায়ীদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তিনি বলেন, রাজধানীতে যেসব মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শপিংসেন্টার আছে সেগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হবে। যদি কোন মার্কেট কিংবা ভবনে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট মালিক এবং দোকান মালিক সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে দু’বছরের ব্যবধানে দুটো আগুনের শিকার অনেকের মাঝে একজন ডিএনসিসি মার্কেটের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান। কাঁচা মার্কেটে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রোকারিজের তিনটি দোকানই পুড়ে ছাই। দোকানে প্রায় ৮০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। দেশের নামী-দামী তারকাচিহ্নিত হোটেলে পণ্য সরবরাহ করতেন হাবিব। বিদেশী পণ্যই বেশি ছিল তার দোকানে। ২০১৭ সালের আগুনে হাবিবের চারটি দোকানের সাড়ে তিন কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গিয়েছিল। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফের দাঁড় করিয়েছিলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এবারও সে স্বপ্ন আগুনের লেলিহান শিখায় অঙ্গার হয়ে গেল। পোড়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে দেখছিলেন পুড়ে যাওয়া পণ্যের ভস্ম। শনিবার সকাল ৭টায় খবর পান মার্কেটে আগুন লেগেছে। বাড্ডার বাসা থেকে ছুটে এসে দেখেন সব শেষ। বললেন একেবারে পথে বসে গেলাম। দু’বছরের ব্যবধানে সবই হারালাম। গতবারের আগুনে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার পণ্য পুড়েছিল। এবার ৮০ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেল। কী নিয়ে কোথায় দাঁড়াব তার কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। গতবার পুড়ে যাওয়ার পর ৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে মার্কেট দাঁড় করিয়ে ছিলাম। ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা থাকলেও সরকার কোন সহায়তা করেনি। কি কারণে বার বার একইভাবে আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে যায়, সেটার রহস্য আগে বের করতে হবে। নইলে আবারও আগুনে পুড়ে ছাই হবে সব।
×