ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত কমিটির টাওয়ার পরিদর্শন, অগ্নিদগ্ধ আরেকজনের মৃত্যু

ভবন মালিক বিএনপি নেতা তাসভিরকে আটক

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৩১ মার্চ ২০১৯

 ভবন মালিক বিএনপি নেতা তাসভিরকে আটক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের শিকার রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারের অন্যতম মালিক বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলামকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে বারিধারার নিজ বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। ডিবি উত্তরের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাজাহান সাজু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আটক তাসভির উল ইসলাম এফ আর টাওয়ারের ভবন পরিচালনা সোসাইটির সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া টাওয়ারের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুককেও আটক করেছে ডিবি পুলিশ। সূত্র জানায়, নক্সার ব্যত্যয় করে নির্মিত এফ আর টাওয়ারের অবৈধ ফ্লোরগুলোর মালিক তাসভির। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এই এফ আর টাওয়ারটি একাধিকবার পরিদর্শন করে এর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এজন্য কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে পরপর দুবার নোটিস করেও কাজ হয়নি। ভবনের ফায়ার সেফটি ইস্যুতে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। প্রসঙ্গত, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফ আর) টাওয়ারের অবস্থান। বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে এ ভবনে আগুন লাগে। এতে ২৫ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এদিকে এদিকে বহুল আলোচিত এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা হয়েছে। গ্রেফতারের আগে ভবনটির মালিককে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তার বিদেশ যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শনিবার ফায়ার সার্ভিস, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা এফ আর টাওয়ার পরিদর্শন করেছেন। ভবনটির টেম্পার নষ্ট হয়েছে বলে মতামত দিয়েছে তদন্ত কমিটি। অগ্নিকান্ডে দগ্ধদের মধ্যে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতালসহ বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। চিকিৎসকদের ভাষ্য মোতাবেক আহতদের অনেকেরই অবস্থা গুরুতর। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। গত ২৮ মার্চ দুপুর পৌনে একটার দিকে রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এ্যাভিনিউয়ের ১৭ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর ২২ তলা এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড হয়। আগুনে শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকসহ ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত অর্ধশত। আহতদের মধ্যে শনিবার আবু হেনা মোস্তফা কামাল নামের একজন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান। টানা পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ভবনটির আগুন নেভানোর পাশাপাশি আটকাপড়া অন্তত দেড় শ’ জনকে উদ্ধার করে। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার সকাল থেকেই অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এফ আর টাওয়ারে কাজ শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। বেলা এগারোটার দিকে প্রথমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির সদস্যরা ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রবেশকারীদের মধ্যে ছিলেন বুয়েট, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও আর্মড ফোর্সেসের প্রতিনিধিসহ নয় জন সদস্য। তারা নিরাপত্তা নিয়ে এফ আর টাওয়ারে প্রবেশ করেন। তারা ভবনের আট, নয় ও দশতলার বিভিন্ন পয়েন্ট ছাড়াও ভবনটির অনেক জায়গা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ভবনের ৮, ৯ ও ১০ তলার কোন এক জায়গা থেকে আগুন লেগেছিল। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তেমনটাই মনে হয়েছে। তবে কিভাবে আগুন লেগেছিল বা কোন জায়গা থেকে আগুন লেগেছে, তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভবনটির দেয়ালে থাকা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতিগুলো বিকল ছিল। রবিবার আট, নয় ও দশ তলার যারা ছিলেন, তাদের বক্তব্য শোনা হবে। আগামী ৩ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আশা করা হচ্ছে। ভবনটির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত অব্যাহত রাখবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদারের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি ভবন পরিদর্শন করেন। অতিরিক্ত সচিব বলেন, জরুরী নির্গমন সিঁড়ি মাত্র দুই ফুট। এতে করে মানুষ বের হতে পারেনি। বিভিন্ন ফ্লোরে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে ব্যবহৃত মালামালের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। তিনি বলছিলেন, ভবনের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে আট, নয় ও দশ তলায় ভয়াবহ আগুন লাগার কারণে ওইসব তলার টেম্পার মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনটির প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় ভবনের টেম্পার চলে যাওয়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উপরের অংশ রীতিমতো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। টেম্পার যাওয়ার কারণে স্বাভাবিক কারণেই শীঘ্রই আর ভবনটির কোন অংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আদৌ ব্যবহার করা যাবে কি না তা দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা ভবনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। এরপর তাদের দেয়া মতামত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। ভবনটি কি প্রক্রিয়ায় আবার ব্যবহারের উপযোগী হবে, তা বিশেষজ্ঞরা জানাবেন। তবে আপাতত ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী। ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ওই ভবনের নক্সা অনুমোদন ও নির্মাণ কাজে ত্রুটি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে এফ আর টাওয়ারের চারদিকে জাল দিয়ে নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজ চলছে। যাতে উপর থেকে কোন কিছু খসে নিচে না পড়ে। ভবনটি থেকে সব মালামাল সরিয়ে নেয়ার পর নিরাপত্তার কারণে ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। প্রতি তলায় পুলিশ রাখা হয়েছে। ভবনের সামনের ও পেছনের অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকেই বিদ্যুত বিভাগের লোকজন ভবনটিতে কাজ করেন। তারা ভবনটির সঙ্গে লেগে থাকা সব বিদ্যুতের তার কেটে দেন। ভবনটিতে থাকা কোন বৈদ্যুতিক তারে যাতে বিদ্যুত সংযোগ না হয়, এজন্য আশপাশে সংযোগ থাকা তারগুলোও কেটে দেয়া হয়। ভবনটি ছাড়া আশপাশের ভবনগুলোতে শনিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়। একইভাবে ভবনটি ছাড়া আশপাশের অন্য ভবনগুলোতেও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। শনিবার বনানীর ওই ভবনটি ঘিরে ভিড় ছিল উৎসুক জনতার। অনেক মানুষ ভবনটি এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেছিলেন। যারা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন, তারা থেমে এক নজর হলেও ভবনটি দেখে গেছেন। কেউ ছবি তুলেছেন। ভবনটির সামনে ও পেছনের অন্তত পাঁচশ’ গজ রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে রাখায় যানবাহন চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ওই রাস্তায় কিছুটা যানজট লক্ষ্য করা গেছে। তবে শনিবার সরকারী ছুটির দিন থাকায় যানজট কিছুটা কম ছিল। শনিবার দুপুরে ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বনানী মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি নিয়মিত মামলা হিসেবে দায়ের হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশকে ভবনটির দূর থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ ভবনের মাঝামাঝি জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভবনটি নিয়ে ঝুঁকি বেড়েছে। বিষয়টি আশপাশে থাকা ভবনগুলোর মালিকদেরও জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ভবনটির সামনে ও পেছনের রাস্তায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ভবনটির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক নামের একজন প্রকৌশলী। আর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভবনের অর্ধেকের মালিকানা ছিল রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের হাতে। এ কারণে নাম সংক্ষেপে ভবনের নামকরণ করা হয় এফ আর টাওয়ার। মূল মালিকরা বিভিন্ন ফ্লোর পাওয়ার পর তারা আবার বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করেছেন। এফ আর টাওয়ার পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন প্রযুক্তি খাতের কোম্পানি কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এমডি তাসভির উল ইসলাম। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভবনটির মালিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাছ চলছে। তাদের অবস্থান জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ভবনটির মূল মালিকের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আইন অমান্য করে ভবনটি তৈরির তথ্য মিলেছে। আইন অমান্য করার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অনিয়মে সহযোগিতা করার অভিযোগে প্রয়োজনে তাদের গ্রেফতার করা হতে পারে।
×