ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দু’শতাধিক দোকান ছাই;###;শত কোটি টাকার মালপত্র শেষ;###;৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

ফের আগুনে পুড়ল ॥ গুলশান ডিএনসিসি মার্কেট

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ৩১ মার্চ ২০১৯

ফের আগুনে পুড়ল ॥ গুলশান ডিএনসিসি মার্কেট

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আবারও রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাঁচা বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও পুড়ে গেছে দুই শতাধিক দোকান। তাতে অন্তত শতকোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। পথে বসেছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার। আগুন এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল যে, পাশের গুলশান শপিং মলেরও অন্তত ১৫টি দোকান ও গোডাউন পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী কাজ করায় মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল নয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অন্যথায় গুলশান শপিং মলসহ আশপাশের ভবনগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল বহু মানুষের। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে পারফিউমের দোকানে লাগলে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে বলে ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট (প্রথম পৃষ্ঠার পর)তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ঘটনার পর পরই মার্কেটের চারদিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার অন্তত সাত ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বিঘিœত হয়েছে। অনেক মানুষ তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি। শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে গুলশান-১ নম্বর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাঁচা ও সুপার মার্কেটে অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটে। মার্কেটটি একতলা। উপরে প্লেন শীট দিয়ে এবং ভেতরে লোহার ফ্রেম দিয়ে মার্কেটটি তৈরি। মার্কেটের পশ্চিম দিকের গেটের নিরাপত্তা কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী বোরহান জনকণ্ঠকে বলছিলেন, যথারীতি প্রতিদিনের মতো তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি যেখান থেকে দায়িত্ব পালন করেন, সেখান থেকে কাঁচা বাজার এক হাজার গজ পূর্ব দিকে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মার্কেট আস্তে আস্তে আলোকিত হতে দেখা যায়। খানিক পরে পুরো মার্কেটের ওপরের দিকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। ততক্ষণে পাশে থাকা গুলশান শপিং মল থেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু হয়। আমরা দ্রুত মার্কেটের কাছে যাই। দেখি পুরো মার্কেটে আগুন লেগে গেছে। মার্কেট বন্ধ থাকায় মার্কেটে থাকা দোকানগুলোর ভেতরে আগুন লেগে তা পুরো মার্কেটের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে থেকে যা বোঝা যাচ্ছিল না। কাঁচা বাজারের সামনে ছয় তলা গুলশান মার্কেটের অবস্থিত হাবিব রেস্টুরেন্টের কাবাব তৈরিকারক হৃদয় জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি হোটেলেই থাকেন। ভোর থেকে আমাদের কাজ শুরু হয়। ভোরে ঘুম থেকে উঠব উঠব এমন সময় মার্কেটে আগুন লাগার শব্দ শুনছিলাম। অনেকেই চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাদের মার্কেটেই আগুন। পরে জানতে পারি পেছনের মার্কেটে আগুন। হোটেলটির ভেতর দিয়ে পেছনে আসতেই দেখি পুরো মার্কেটে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। বেশিক্ষণ আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। আগুনের তাপে সিদ্ধ হওয়ার উপক্রম। ততক্ষণে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন ভেতরে ভেতরে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাইরে থেকে অতটা বোঝা যাচ্ছিল না। যতক্ষণে আগুনের খবর মানুষ জানতে পেরেছে, ততক্ষণে মার্কেটের ভেতরের সব দোকানে আগুন লেগে গেছে। আগুন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মনে হচ্ছিল আগুন গুলশান শপিং মল, ডিএনসিসির পাকা মার্কেট, পাশের র‌্যাংগস ভবনসহ ধরে যাবে। এদিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে মার্কেটে দোকানিসহ তাদের লোকজন সেখানে হাজির হয়। কারণ পাশের মার্কেটে তাদের দামি জিনিসপত্রের দোকান আছে। এরপর তারা তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যার যার জিনিসপত্র নিরাপদ জায়গায় সরাতে থাকেন। অনেকেই বহু ফানির্চার ও অন্যান্য জিনিসপত্র মার্কেটের পেছনের র‌্যাংগস ভবনের পাশে রাস্তার পাশে ফেলে রেখেছেন। ফায়ার সার্ভিস জানায়, খবর পেয়েই তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়। ফায়ার সার্ভিসের পর পরই সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়। মার্কেটটিতে চারদিক দিয়েই প্রবেশের বড় বড় রাস্তা আছে। ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোকে ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছানোর জন্য বাড়তি বেগ পেতে হয়নি। তারা চারদিক দিয়ে পানি ছিটাতে থাকে। তাদের সঙ্গে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সহায়তা করেন। তারপরেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে এজন্য ডিএনসিসির কাঁচা মার্কেট ও গুলশান শপিং মলেও পানি ছড়াতে থাকে। পর্যাপ্ত পানি দেয়ার কারণে আগুন আর অন্য কোথাও ছড়াতে পারেনি। সকাল নয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সকাল দশটায় পুরোপুরি অগ্নিনির্বাপণ শেষ হয়। এদিকে আগুন লাগার পর পরই মার্কেটের চারদিকের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দুপুর নাগাদ পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। মার্কেটটির সঙ্গে লাগোয়া ছয় তলা গুলশান শপিং মল ঘুরে দেখা গেছে, উত্তর দিকের কাঁচা বাজার লাগোয়া শপিং মলটির নিচ তলার চারটি, দ্বিতীয় তলার চারটি ও তৃতীয় তলার তিনটি দোকান এবং চারটি গোডাউন পুড়ে গেছে। গোডাউনগুলোতে অন্তত পাঁচ লাখ টাকার মালামাল ছিল। মালামালের মধ্যে সবই ছিল মাছ-মাংসসহ অন্যান্য খাবারের জিনিসপত্র। গোডাউন তিনটি গুলশান শপিংমলে থাকা খাবার হোটেলের ছিল। দেখা গেছে, আগুনে মাছ-মাংস, তেলসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। মাঝ বরাবর ৭৬টি মাছ-মাংসের দোকান ছিল। প্রতিটি দোকানে একাধিক ফ্রিজ ছিল। এসব ফ্রিজে থাকা মাছ-মাংস পুড়ে গলে কু-লী হয়ে পড়েছে। আগুনে মার্কেট তৈরির প্লেন শীট ও লোহার এঙ্গেলগুলো পর্যন্ত দুমড়ে মুচড়ে গেছে। শুধু দক্ষিণ দিকের ২০টি মুরগির দোকান তুলনামূলক কম পুড়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বাজারটিতে দুই শতাধিক দোকান আছে। যার মধ্যে ক্রোকারিজ, বিভিন্ন পারমিউমের দোকান আছে। এছাড়া মাছ-মাংসের দোকানও আছে। প্রতিটি দোকানেই ফ্রিজ আছে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। সেই আগুন পারমিউমের দোকানে ধরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া আগুন ফ্রিজসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রে ধরলে একের পর এক ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হতে থাকে। এ সময় আগুন আরও মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আগুন নেভানোর পর সেখানে ভিড় করেন দোকানিরা। তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অনেকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। এদিকে গুলশান থানা পুলিশের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার জন্য একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পে শনিবার বিকেল চারটা নাগাদ ৮৯ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। কোন দোকানের ক্ষতি ২০ লাখ টাকার নিচে নেই। কোন কোন দোকানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার কাছাকাছি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী জামাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কেটটিতে তার দুইটি দোকান ছিল। একটি ক্রোকারিজের দোকান। অপরটি বিভিন্ন খাবার ও মসলার দোকান। দুইটি দোকানে তার অন্তত ৬০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে। আমি একেবারে পথে বসে গেছি। এর আগেও একবার আগুনে সব পুড়েছে। এবার পুড়ে রীতিমতো পথে বসিয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস আগে ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে প্লেন শীট কিনে এবং লোহা দিয়ে দোকানগুলো তৈরি করেন। এখনও অনেক কাজ বাকি। তার মধ্যেই এমন আগুন। সত্যিই হতবাক করার মতো ব্যাপার। আগুন লাগার বিষয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। একটি মাংসের দোকানের মালিক মিজান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কেটটিতে ২১২টি দোকান আছে। এসব দোকানের মধ্যে আছে ক্রোকারিজ, মসলা, মুদি দোকান, ফলের দোকানসহ নানা ধরনের দোকান আছে। তবে সবচেয়ে বেশি মাছ-মাংসের দোকান। প্রতিটি দোকানে একাধিক ফ্রিজ ছিল। এসব ফ্রিজ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ভয়াবহ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলছিলেন, ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিকা-ে মার্কেটটি পুড়ে ধসে পড়েছিল। এরপর আবার আমরা কষ্ট করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এবার পুরোপুরি পথে বসার যোগাড়। ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারের কাছে পুনর্বাসনের দাবি করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, মার্কেটটিতে আগুন নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। মার্কেট নিয়ে মামলা আছে। মামলা জটিলতার কারণে এখানে স্থায়ী একটি মার্কেট গড়া যাচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেবেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, ২০১৭ সালে আগুন লাগার পর তিন থেকে চারবার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়নি তারা। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, পরিকল্পনা বা নিয়মের বাইরে তৈরি হওয়া রাজধানীর বিভিন্ন ভবন আগামী ১৫ দিনের মধ্যে চিহ্নিত করা হবে। কোথাও অপরিকল্পিত, অবৈধ ভবন থাকলে তথ্য দিবেন। অবৈধ ভবন প্রয়োজনে সিলগালা করা হবে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি মালিক, ব্যবসায়ী, ডেভেলপার এমনকি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেও তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদন জনতার সামনে প্রকাশ করা হবে। অন্যদিকে অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ ও ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, আইন কর্মকর্তা, সম্পত্তি কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী (অঞ্চল-৩) এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একজন প্রতিনিধি। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুত) সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটি আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এদিকে শনিবার বিকেলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা আর শ্রমিকদের ২০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে বলে জানান ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান। গুলশান কাঁচাবাজারে আগুনের তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোঃ শামীমকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটি সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
×